ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পারল না, পারল বাংলাদেশ

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | রবিবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

১৮৯০ সালে ব্রিটিশ সরকার বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে আরকানের (বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য) রেল যোগাযোগের গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রথম জরিপ কাজ চালায়। এরপর ১৮৯৩, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় জরিপ চলে। ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালে চট্টগ্রামদোহাজারী পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে পরিকল্পনা অনুসারে কক্সবাজার পর্যন্ত বাকি অংশে রেলপথ তৈরি হয়নি।

ব্রিটিশরা ১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা; ১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম ও ১৮৬০ সালে আরাকান দখল করে। পরে পাকিস্তান স্বাধীন হলে ১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার একটি জরিপ চালিয়ে এই প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় নিরূপণ করে। কিন্তু জরিপে কিছু অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হওয়ায় ১৯৫৭ সালে আবারও জরিপ কাজ চালানো হয়। পরে প্রকল্পটি আর এগোয়নি।

স্বাধীনতার পর রেললাইন প্রকল্পটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৯৮ সালে জার্মান সরকারের আর্থিক সহায়তায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের ২য় রুট হিসাবে বাস্তবায়নের প্রস্তাব আসে। তবে তা গৃহীত না হলেও পরে ২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক নিয়োগের দরপত্র প্রদান করা হয়, যেখানে ৪টি কোম্পানি অংশগ্রহণ করে। পরের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে রেল প্রকল্পটি আবারও মুখ থুবড়ে পড়ে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসার পর প্রকল্পটি নিয়ে আবারও নাড়াচাড়া শুরু হয়। ২০১০ সালে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে প্রকল্পটি (ডিপিপি) অনুমোদন পায়। সে সময় এর ব্যয় ধরা হয় ১৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার শহরতলীর বাস টার্মিনালের কাছে ‘দোহাজারীরামুকক্সবাজার’ এবং ‘রামুঘুমধুম মিটারগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিন্তু অর্থ সংস্থানের অভাবে প্রকল্পটি এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০১৭ সালে প্রকল্পটিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে ১৮ হাজার ৩৫ কোটি টাকা করা হয়। এরপর ২০১৮ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এতে অর্থায়ন করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।

নির্মাণ কাজ শেষে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত ৫ নভেম্বর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা জিআইবিআরের একটি স্পেশাল ট্রেন ওইদিন সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশন বিল্ডিংয়ে পৌঁছে। দোহাজারীকক্সবাজার নতুন রেলপথের সবকিছু ঠিক আছে কিনা সেটি যাচাই করতেই গত রোববার ওই পরিদর্শন ট্রেন চালানো হয়।

চট্টগ্রামকক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। দোহাজারী থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া, রামু হয়ে পাহাড় ও নদীপথ পেরিয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত চলে এসেছে এই রেললাইন। এই পথে আছে ৯টি রেলওয়ে স্টেশন, চারটি বড় ও ৪৭টি ছোট সেতু, ১৪৯টি বক্স কালভার্ট এবং ৫২টি রাউন্ড কালভার্ট। এছাড়া সংরক্ষিত বন এলাকায় রেললাইন স্থাপন করায় বন্যহাতি ও বন্যপ্রাণী চলাচলের জন্য ওভারপাস নির্মাণ করা হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম।

এদিকে জেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্বে ঝিলংজা ইউনিয়নের হাজিপাড়া এলাকায় ২৯ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন আইকনিক রেলস্টেশন। ঝিনুকের আদলে তৈরি এ স্টেশন ভবনটির আয়তন এক লাখ ৮২ হাজার বর্গফুট। ছয়তলা বিশিষ্ট স্টেশনটি নির্মাণে বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগসুবিধা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এখানে থাকছে তারকা মানের হোটেল, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, শিশুযত্ন কেন্দ্র, পোস্ট অফিস, কনভেনশন সেন্টার, ইনফরমেশন বুথ, এটিএম বুথ, প্রার্থনার স্থান, লাগেজ রাখার লকারসহ অত্যাধুনিক সব সুবিধা। রেলস্টেশন নির্মাণে খরচ হয়েছে ২১৫ কোটি টাকা।

দোহাজারীকক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে দেশের ৪৫তম জেলায় যুক্ত হলো রেল। এটি সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত মেগা প্রকল্প। এর মাধ্যমে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহরে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করা যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

লেখক ও গবেষক নুরুল আজিজ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারে রেললাইন নির্মাণের জন্য ব্রিটিশ চেষ্টা করল, পারল না। পাকিস্তান চেষ্টা করল, পারল না। আর আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর রেললাইন পেলাম। অবশেষে আমরা বাঙালিরা সেটা পারলাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযেসব প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তি স্থাপন
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে ইতিহাস, স্বপ্নপূরণ