ব্রিকস শব্দটি দ্বারা স্পষ্ট কিছু বুঝা না গেলেও প্রকৃতপক্ষে এই শব্দটির ইংরেজি হয় ‘BRICS’ যা পাঁচ দেশের প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত। অর্থাৎ ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা এ দেশসমূহ নামের প্রথম অক্ষর বসিয়ে শব্দটি তৈরি হয়েছে ব্রিকস। অবশ্য এ শব্দটি উৎপত্তির একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ২০০১ সালে গোল্ডম্যান সেকস্ (GOLDMAN SACHS) এর প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও নেইল (O’NEIL) ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, দ্রুত বর্তমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা ২০৫০ সালের মধ্যে সমগ্র গ্লোবাল অর্থনীতিকে ডোমিনেইট করবে। এর পরবর্তী ২০০৯ সালের ১৬ জানুয়ারি প্রথম ‘BRICS’ গঠিত হয়। এ সময়ে ব্রিকস্ এর সদস্য ছিল ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন। অবশ্য পরবর্তীতে ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেয়। ফলে তা হয়ে যায় ‘BRICS’। ২০০১ সালে পোল্ডম্যান সেকস্ এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ও’ নেইল যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার প্রায় ২২ বছর পর এ ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা লাভ করতে যাচ্ছে। ও’নেইল ছিলেন একসময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সরকারের অর্থ বিভাগের কনিষ্ঠ মন্ত্রী। ২০০১ সালে তিনি ‘ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস্– পত্রিকায় এক নিবন্ধে চারটি বিরাজমান অর্থনীতির দেশকে একটি নতুন শব্দে বর্ণনা করেছিলেন যা ‘BRICS’ নামে পরিচিতি পায়। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন এ চারটি দেশের প্রথম আদ্যক্ষর নিয়ে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘BRICS’। পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে জোটের পরিচিতি দাঁড়ায় ‘BRICS’। জিম ও’নেইল ২০২১ সালে ‘ফাইন্যন্সিয়াল টাইমস্’– এর আর এক নিবন্ধে মতামত প্রকাশ করেন যে, ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে কেবল চীন তাদের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে ছাড়িয়ে গেছে। ভারতও খুব একটা পিছিয়ে নেই। তবে ২০০১ সালের তুলনায় একেবারেই ভালো করতে পারেনি ব্রাজিল ও রাশিয়া। এসব দেশ কীভাবে তাদের জনগোষ্ঠীকে উচ্চতর আয়ের স্তরে সফলভাবে নিয়ে যেতে পারে, সেই বড় চ্যালেঞ্জের বিষয়টিই অমীমাংসিত রয়ে গেছে। জিম ও’নেইল এর তথ্য ভিত্তিক এই মূল্যায়ন সংশ্লিষ্ট দেশের প্রবৃদ্ধির ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। যেমন– বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশকে চীনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭৬ শতাংশ, ভারতে হয়েছিল ১১০ শতাংশ, রাশিয়ায় হয়েছিল ৬০ শতাংশ, ব্রাজিলে ৪৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়েছিল ৪১ শতাংশ। তারপরই দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি অনেকাংশে হ্রাস পায়, বিশেষ করে ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগ দেয়ার পর। পরবর্তী দশকে চীন ও ভারত ভাল করলেও ২০২২ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশ, ব্রাজিলের ছিল ৭ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ। তবুও এ পাঁচটি দেশের নেতারা নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী।
বিশ্বের মহাদেশগুলোর মেরুকরণে দেখা যায়, পাশ্চাত্যের দেশগুলোর অধিকাংশ দেশ হয় ধনী। তাদের অর্থনীতির ভিত্তি খুবই মজবুত। যদিও পাশ্চাত্যে সকল দেশ সম ক্ষমতা সম্পন্ন নয়। তবুও বিভিন্ন ধরনের জোট বা সংস্থা গঠন করে তারা সব সময় একত্রিত থাকার চেষ্টা করে। এ কারণে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর বড় ভাই আমেরিকা যে কোন বিষয়ে যে রূপ সিদ্ধান্ত দেয়, অন্যান্য দেশ সেই সিদ্ধান্তকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করে। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কিছু কিছু মতভেদ দেখা যায়। অথচ মৌলিক বিষয়ে এসব দেশগুলোর মধ্যে গভীর সুসম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো হয় অনেকাংশে দরিদ্র। এসব দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী নয়। এদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন কম তেমনি মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিমাণও কম। তাছাড়া এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো সংঘবদ্ধও নয়। এদের মধ্যে দুই একটি জোট থাকলেও তা কার্যকর নয়। অধিকাংশ এসব দেশগুলো নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে নিয়োজিত। ফলে কী বিশ্ব রাজনীতি, কী বিশ্ব অর্থনীতি, কোনটার মধ্যে এ দেশগুলো কোন ভূমিকা রাখতে পারে না। তাছাড়া পশ্চিমা দেশের জোট ‘ন্যাটো’– এর ন্যায় কোন জোটও এ দেশগুলোর নেই। সেই দিক দিয়ে গঠিত ‘ব্রিকস’ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে নতুন করে শক্তি যোগাবে।
প্রথমে চারটি দেশ মিলে ‘ব্রিকস’ গঠন করে ২০০৯ সালে। ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকস–এ যোগ দেয়। ২০১১ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে ব্রিকসের অর্জন খুব বেশি নয়। সবচেয়ে বড় অর্জন একটি ব্যাংক। এ ব্যাংক গঠিত হয় ২০১৫ সালে। ব্যাংকটির নাম হয়– ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’। এই ব্যাংক এখন পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। যদি এ ব্যাংককে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে তুলনা করা হয় তবে এখনো পর্যন্ত ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’ অনেক পিছিয়ে আছে। বিশ্ব ব্যাংক শুধু ২০২২ সালেই ঋণ দিয়েছে ১০ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার। ব্রিকস এর এ নতুন ব্যাংক আর্থিকভাবে এখনও শক্তিশালী না হলেও ব্রিকস এর সদস্য দেশগুলো চায় মার্কিন ডলার বিহীন বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এ কারণে বাণিজ্য সাম্প্রসারণের সাথে সাথে ব্রিকস এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছে ভারত ও চীন। সাথে রাশিয়াও যুক্ত হয়েছে। এ দেশগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলারের বাইরে একটি লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ কারণে বর্তমান বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থায় যে ‘সুইফট’ নীতি চালু আছে তার একটি বিকল্প পদ্ধতি বের করাই হলো ব্রিকস এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রাথমিক অবস্থায় যে বিষয়গুলো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা হলো ‘ব্রিকস’ পে নামে একটি লেনদেন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনের পদ্ধতি বের করা ও ডলারবিহীন আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
অতি সম্প্রতি পণ্য মূল্যবৃদ্ধি ও ডলার সংকটের কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো কঠিন সময় পার করছে। এ সব দেশগুলো এক বাক্যে উচ্চারণ করছে বিশ্বে ডলারের আধিপত্য অবশ্যই নিঃশেষ করতে হবে। আর এ মানসিকতা ব্রিকসকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ডলারের আধিপত্য খর্ব করার জন্য ব্রিকস এর কয়েকটি দেশ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চীনের মুদ্রা (ইউয়ান) আর ভারতের মুদ্রা রুপিতে চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ভারত রাশিয়ার সাথেও দুই দেশের নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য শুরু করেছে। সম্প্রতি ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য শুরু হয়েছে ভারতীয় রুপি ও বাংলাদেশের টাকার মাধ্যমে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারকে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্র্ধে আমেরিকা সৌদি আরবের সাথে এক চুক্তি করেছিল যে তেল রপ্তানির আর্থিক লেনদেন হবে মার্কিন ডলারে। সেই থেকে ডলার হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান হাতিয়ার। এখন ব্রিকস এর মাধ্যমে ডলারের আধিপত্য যদি কমে যায় তবে পশ্চিমা দেশগুলোর আয়, স্বার্থ এবং আধিপত্য হ্রাস পাবে। বিশেষ করে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাবে। আর তা হবে বিশ্ব অর্থনীতির নতুন মেরুকরণ।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি