রাতের সাড়ে দশটায় সামাজিক অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে ৯০ ব্যাচের এক বন্ধুর প্রয়োজনীয় কাজের ফোনে জানলাম ম্যারাডোনা মারা গেছে। উচ্ছৃঙ্খল, ক্ষ্যাপাটে জীবনযাপনের জন্য তার প্রতি কিছুটা ক্ষোভ থাকলেও মনের মধ্যে ভালবাসা অচিন্তনীয়। বেশ কষ্ট নিয়ে বাসায় ঢুকতেই ক্লাস টেনে পড়া বড় ছেলে বলে বাবা তোমার ম্যারাডোনা মারা গেছে। বন্ধু গোপাল (৯০ ব্যাচ) একটা অনুষ্ঠানের দাওয়াত দিতে ফোন করলে কথোপকথনের প্রথম শব্দ দোস্ত, ‘আমাদের ম্যারাডোনা’ আর নেই। তার সাথে কথা শেষ করে বিষণ্ন মনে বিছানায় শুয়ে ভাবনায় আসে-কেন আমার ম্যারাডোনা, আমাদের ম্যারাডোনা?
আমাদের হাতেখড়ির সময়কাল ১৯৭৮-৭৯। শিশু মনে প্রশ্ন ফুটবল খেলায় বিশ্বসেরা কোন দেশ, অগ্রজদের কাছ থেকে উত্তর আসে আর্জেন্টিনা (১৯৭৮ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন)। স্বাভাবিক ভাবে শিশুমন সেরার সাথে থাকতে চায়। ১৯৭৮ সালে বিশ্বকাপ জয়ী স্কোয়াডে জায়গা মেলেনি ১৭ বছর বয়সী সেনসেশন ম্যারাডোনার। সেটা নিয়ে প্রচুর আলোচনা, মনের চিলেকোঠায় ম্যারাডোনার আগমন। ১৯৮২ বিশ্বকাপ ফুটবল, টিভি পর্দায় প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল দেখা। উদ্বোধনী ম্যাচে আর্জেন্টিনা বনাম বেলজিয়াম, সবচেয়ে আলোচিত খেলোয়াড় ডিয়েগো ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে হেরেছে। আমাদের হিরোরা প্রথম চোটে মার খায়। পরে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠে বীর বেশে। সেবারের চ্যাম্পিয়ান স্বাগতিক ইটালির কাছে হারের ম্যাচে ম্যারাডোনাকে ২৩ বার ফাউলের শিকার হতে হয় (এক ম্যাচে ফাউলের বিশ্বরেকর্ড)। মনের গভীরে বার বার মার খাওয়া ম্যারাডোনা। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে ধরাশায়ী আর্জেন্টিনা। মনের গহীনে আর্জেনটিনার প্রতি অনুরাগ বৃটিশ বিরোধী বিরাগের কারণে ( দু’শ বছরের শাসনের নামে শোষণ, সদ্য পড়া/ শোনা তিতুমীর, হাজী শরীয়তউল্লাহ, সূর্যসেন, প্রীতিলতা)। ১৯৮৬ সালে মেঙিকো বিশ্বকাপ ফুটবল ম্যারাডোনাময়। একক কৃতিত্বে আর্জেন্টিনাকে এনে দেয় শিরোপা। হিরো নাম্বার-১। ক্লাব ফুটবল ও তখন আমাদের আগ্রহের/ আলোচনার বিষয় সেখানে ও ম্যারাডোনার জয়জয়কার। ১৯৮৭ আর ১৯৯০ সালে ন্যাপোলির হয়ে সিরি- এ জিতেছেন। ১৯৯০ এর বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের এসএসসি পরীক্ষার পর। সেখানে ও সবাইকে ছাপিয়ে ম্যারাডোনা- আর্জেন্টিনা রানারআপ।
১৯৯৪ বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালে কৈশোর পেরিয়ে যুবক তখনও ম্যারাডোনা বন্দনা। সে বিশ্বকাপে ২ ম্যাচ খেলা বুড়োঘোড়া তেমন একটা সফলতা না পাওয়ায় আর্জেন্টিনাও ব্যর্থ। তবুও প্রথম প্রেম, ভালো লাগা-ভালবাসা ম্যারাডোনা ও আর্জেন্টিনা।
আমার ম্যারাডোনা দর্শনের অভিজ্ঞতাও একটু বলে ফেলি। ২০১০-১২ তিন বছরে চারবার নানা কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (চট্টগ্রামের মানুষের মাঝে দুবাই) যেতে হয়েছিল। সেখানে গেলে থাকি রায়হান অথবা মিঠুর (দু’জনেই কলেজিয়েট ৯০) বাসায়। সেখানে কাজ ও বেড়ানোর সময়টায় মাথায় ঘুরে ফুটবল দেবতা আশেপাশেই আছে।
১২ সালে মিঠুসহ ওয়াদি ওয়াইল্ডে ঢুকবো টিকেট কাটা শেষ, মিঠুর কলিগ ফোনে জানালো সারজাহ ফুটবল স্টেডিয়ামে ম্যারাডোনার টিম আল ওয়াসেল (কোচ) ক্লাবের ম্যাচ আছে। কিসের ওয়াদি ওয়াইল্ড, স্বপ্নের নায়কের দেখা পেতে সোজা স্টেডিয়ামে।
নায়ককে কাছ থেকে দেখলাম দু’চোখ ভরে। তবে তার দলের খেলা হতাশাজনক। যাই হোক, আমাদের ৯০ এর বন্ধুদের কাছে নবাব সিরাজদৌলা বলতে যেমন অভিনেতা আনোয়ার হোসেন তেমনভাবে ফুটবলারের প্রতিরূপ ম্যারাডোনাই। শৈশব, কৈশোরে সেই তো নায়ক।