দেশের অর্থনীতিবিদরা বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ধস নামার আশঙ্কা করছেন। বৈশ্বিক মন্দা এবং দেশে ডলারের তীব্র সংকটে অর্থনীতি এমনিতেই নাজুক। তার উপরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে দেশ। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির এ দুঃসময়ে রাজনৈতিক সমঝোতা যেখানে জরুরি, সেখানে অস্থিরতা বাড়লে অর্থনীতিতে শুধু ধসই নামবে না, আরও অনেক কিছু হতে পারে। এতে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি বৈদেশিক ও সামাজিক খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে অর্থনীতির কথা চিন্তা করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংস কর্মসূচি পরিহারের আহ্বান জানিয়েছেন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁদের মতে, অর্থনীতি ও রাজনীতি একে অন্যের পরিপূরক। তাই সংহিস কর্মসূচি দিয়ে ব্যবসা–বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্ত করলে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার বোঝা দেশের সব মানুষকে বহন করতে হবে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ও সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একটি চিত্র উঠে এসেছে, সেটি হলো– হরতাল–অবরোধে প্রতিদিন গড়ে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ১৮ দিনে সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে এক লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিবহন খাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা। পণ্য পরিবহণ ও মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ক্ষতি ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, , ১ দিনের অবরোধ বা হরতালে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে প্রায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। ১০১৪–১৫ সালে বিরোধী দলের আন্দোলনের সময় প্রতিদিন ক্ষতি হতো ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকা। এখন অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে। একটির সঙ্গে অপরটির সম্পৃক্ততা বাড়ছে। এসব কারণে ক্ষতির পরিমাণও বেশি হচ্ছে।
এফবিসিসিআইর সভাপতি মাহবুবুল আলম সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় এমন কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এভাবে অর্থনীতির ক্ষতি হতে থাকলে এক সময় ঘুরে দাড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সিমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ১ দিনের অবরোধ বা হরতালে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ক্ষতি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। পাশাপাশি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে। তাদের বিক্রি কমে যাচ্ছে। এতে কমছে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে উৎপাদনও কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যায়, জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে শিল্পোৎপাদন কমেছে। জুলাইয়ে শিল্পোৎপাদন বেড়েছিল ১৯ শতাংশ। আগস্টে বেড়েছে সাড়ে ১০ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের জুলাই–আগস্টের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা সামান্য বেড়েছে। বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সংকটে শিল্প খাতের ওপর দিয়ে যে ধকল যাচ্ছে, তা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে এসেছে রাজনৈতিক অস্থিরতার ধকল।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন, শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্য খাতে এ অস্থিরতার ফলে খেলাপি ঋণের মাত্রা বেড়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই তখন ঋণ নবায়নে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। এর সুযোগ নেবে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এখন সব উদ্যোক্তার মধ্যেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। এটি দীর্ঘ সময় থাকবে বলে তাঁরা মনে করছেন। ফলে অনেকে নির্বাচনের পরও কোনো বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন না। এতে সার্বিক অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়বে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি একদিকে যেমন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি দেওয়ার প্রমাণ ও অভিজ্ঞতা দিতে পারেনি; অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে অভিহিত করার পর সেই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন সংবিধানে কোনোভাবেই করা সম্ভব নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকলে সর্বোচ্চ আদালত থেকেই তা নিষ্পত্তি করতে হয়। সংবিধানে যেহেতু সেই রায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে, তাই নতুন করে সেই ব্যবস্থার প্রয়োগ করতে গেলে তা সাংঘর্ষিকতার কারণে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। এসব বিষয়ে বিএনপির নেতারা জেনেও কেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে গুরুত্ব না দিয়ে সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আন্দোলন করতে গেলেন, তা–ই বোধগম্য নয়। কারণ এ ধরনের আন্দোলন করে যদি দেশে কোনো ঐক্যবদ্ধ গণ–অভ্যুত্থান সৃষ্টি করা না যায়, তাহলে সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব নয়।’ তাই আন্দোলন বিষয়ে বিরোধী পক্ষের বিকল্প চিন্তা করা উচিত।