‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক : কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় ব্যবসায়ী সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে। বিদ্যমান ১৫ শতাংশের সঙ্গে নতুন ৩৫ শতাংশ যুক্ত হয়ে মোট শুল্ক হার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। শুল্কহার কমিয়ে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারের প্রতিনিধিদের আলোচনা হলেও কোনো সুফল আসেনি। পুনরায় আলোচনার চেষ্টা হচ্ছে বলে সরকারের তরফে জানানো হয়েছে। তবে সে চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ফলে ব্যবসায়ী নেতারা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্য এখন একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তী সরকার কোনোভাবেই ধস প্রতিরোধ করতে পারছে না। কোনোরূপ রাখ–ঢাক না করেই তারা তাদের অভিমত তুলে ধরেছেন। দেশের বিশিষ্ট রফতানিকারক, ব্যবসায়ী ও বিজেএমইর সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেছেন, আমরা ব্যবসায়ীরা রফতানি খাতকে সম্মানজনক পর্যায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তার মতে, গত ৪০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে তিনি রফতানি খাতের এমন সংকট দেখেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে এ কে আজাদ বলেছেন, সেখানে সরকার ও ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কাজ করছে। লবিস্ট নিয়োগ করেছে। প্রতিটি স্তরে আলোচনা করেছে। অথচ বাংলাদেশে আমরা এমন সুযোগ পাইনি। উল্লেখ করা যেতে পারে, শুল্ক বিষয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করেনি। ফলে শুল্ক কমানোর বিষয়ে প্রতিযোগী দেশগুলো অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ কিছু করতে পারেনি। তার হাতে আছে আর মাত্র কয়েক দিন। দুই দফা আলোচনায় ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে সরকার এখন রফতানিকারক, ব্যবসায়ী ও বেসরকারি খাতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারের অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাবই যে দায়ী, তাতে সন্দেহ নেই।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা এ শুল্ক শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়। এর সঙ্গে রাজনৈতিক–অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি জড়িত। ফলে এটিকে শুধু শুল্ক হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে দরকষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সেবা খাতের বিষয়টি একদমই সামনে আনা হয়নি। উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্য যারা দরকষাকষির সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাদের মুখে এটি নিয়ে কোনো কথা নেই। অথচ সেবা খাতের সঙ্গে আমাদের তৈরি পোশাক, ওষুধ ও অন্য রফতানি খাতও জড়িত।’ অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে সফল হবে না বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, ‘দুর্বল সরকার দরকষাকষিতে সফল হয়েছে এ নজির খুব কম। একটি অসমন্বিত সরকার তার সবচেয়ে বড় সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পেরেছে এমন উদাহরণ নেই। এটি এমন এক সমন্বয়হীন সরকার, যার বিভিন্ন কাজের নেতৃত্বে কে আছেন, এটা বোঝা যায় না। বর্তমানে যেহেতু সরকার দুর্বল, সেহেতু শুল্কের আলোচনায় দুর্বলতার ঘাটতি পূরণ করতে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন ছিল। এখানে সেটি হয়নি।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশই তৈরি পোশাক। আর তার প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি ছিল তৈরি পোশাক। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে রীতিমতো বিপর্যয় নেমে আসবে। উদ্যোক্তারা অভিযোগ করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনাকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলটি আমলানির্ভর। সেখানে ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা না থাকায় আলোচনায় ইতিবাচক ফল আসেনি। তাঁরা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত, অকর্মণ্যতা ও ব্যর্থতার কারণে অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। রেমিট্যান্সসহ দুয়েকটি বাদে অর্থনীতির কোনো সূচকই ঊর্ধ্বমুখী ইতিবাচক নয়। ব্যাংক খাত, শেয়ার বাজার, আমদানি–রফতানি, রাজস্ব আহরণ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান– সব ক্ষেত্রেই হতাশার চিত্র দৃশ্যমান।
বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্রুত একটি সমাধান প্রত্যাশা করেন। তাঁরা বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে।