‘প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মেডিকা বর্ডারে আমার চোখের সামনে দুজন মারা যায়। আমিও জ্ঞান হারিয়েছিলাম,’ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে পোল্যান্ড যেতে যেতে এভাবেই নিজের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলেন বাংলাদেশি ছাত্র শাকিল হোসেন। শাকিল ইউক্রেনের খারকিভ ন্যাশনাল মেডিকেল ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী ভিসা নিয়ে পূর্ব ইউরোপের দেশটিতে যান মানিকগঞ্জের এই তরুণ। খবর বিডিনিউজের।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে, তখনও শাকিল ভেবেছিলেন, রুশ সীমান্তবর্তী খারকিভ আক্রান্ত হবে না। খারকিভের মেয়র পুতিনের সাপোর্টার। তাই আমি দোটানায় ছিলাম, যাব কি যাব না। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি মিসাইলের প্রচণ্ড বিস্ফোরণে পুরো শহর কেঁপে উঠে। আমি আর থাকার সাহস করতে পারিনি। শাকিল বলেন, কোনো রকমে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ছুটলাম ট্রেন স্টেশনের দিকে। ট্রেনে উঠার মরিয়া চেষ্টা করছি, মাথার উপর প্রচণ্ড শব্দে যুদ্ধবিমান উড়ছে, বোমা পড়ছিল। মনে হচ্ছি, যুদ্ধের কোনো গেইমের ভেতর ঢুকে পড়েছি।
শুরুতে খারকিভ থেকে পোল্যান্ড সীমান্তবর্তী শহর লিভভ যেতে চেয়েছিলেন শাকিল। কিন্তু স্টেশনে সবাই তখন পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ শহর লিভভেই ছুটছেন। অনেক চেষ্টা করেও শাকিল এবং তার বাংলাদেশি বন্ধু মোয়াজ লিভভগামী ট্রেনে উঠতে পারেননি। বাধ্য হয়ে রাজধানী কিয়েভের পথে রওয়া হন তারা। লিভভের ট্রেনে উঠতে না পেয়ে আমরা কিয়েভের দিকেই রওয়ানা হলাম। কেউ তো কিয়েভে যাচ্ছিল না, তাই ট্রেন ফাঁকা ছিল। আশা ছিল, কিয়েভ থেকে নিশ্চয়ই কোনো দিকে যেতে পারব। কিয়েভ থেকে পরে লিভভ যাওয়ার ট্রেনে উঠতে পারেন শাকিলরা।
‘আমরা যখন লিভভ পৌঁছাই, তখন সেখানে এত মানুষ ছিল যে হাঁটা যাচ্ছিল না। মেডিকা বর্ডারে যেতে আমরা বহু কষ্টে ১০ হাজার ইউক্রেনীয় মুদ্রা দিয়ে একটি গাড়ি ঠিক করি। শহর থেকে বর্ডারের দূরত্ব ৯৩ কিলোমিটারের মতো। ৩০-৩৫ কিলোমিটার যাওয়ার পর আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাকি ৪০ কিলোমিটারের বেশি পথ আমরা হেঁটে এসেছি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, বরফ পড়ছিল। টানা তিন দিন ছুটে ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আমরা মেডিকা সীমান্তে পৌঁছাই। কিন্তু সেখানে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না। আগে ইউক্রেনের নারী ও শিশুদের পার করা হচ্ছি। অন্য দেশের মেয়েদেরও যেতে দেওয়া হচ্ছিল।
শাকিল বলেন, আমাদের একটি পেট্রোলপাম্পে কাছে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সেখানে তখন তাপমাত্রা মাইনাস ৭, তুষার পড়ছিল। পাশেই জঙ্গল থেকে ডালপালা এনে আগুন ধরিয়ে আমরা গরম থাকার চেষ্টা করছিলাম। ওইদিন রাত গেল। পরদিনও গেল, আমরা অপেক্ষায় আছি। ১ মার্চ ভোররাত ৩টার তারা আমাদের হেঁটে হেঁটে বর্ডার পার হতে বলে। বর্ডারে গেটের সামনে আবার আমাদের আটকে দেয়। সেখান প্রচণ্ড ভিড় আর ঠেলাঠেলি। তারমধ্যেই আমার চোখের সামনে আফ্রিকা থেকে আসা দুই শিক্ষার্থী মারা যায়।
তখন শাকিলও এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ২৫ তারিখ হোস্টেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি প্রাণভয়ে কেবলই ছুটেছিলেন। সীমান্তে কষ্ট সহ্য করার এক পর্যায়ে ইউক্রেনে ফেরত যাওয়ার কথাও ভাবছিলেন। বরফের মধ্যে টানা পাঁচ দিন বাইরে, খাবার নেই। এটা সহজ বিষয় নয়। বর্ডারে আমারও খুব অসুস্থ লাগছিল। সঙ্গে থাকা ভাইদের বলেছিলাম, আমার দিকে খেয়াল রাখতে। ভিড়ের মধ্যে পড়ে গেলে যেন আমাকে ফেলে না যায়। বহু কষ্টে বর্ডার পার হই।
ইউক্রেন বর্ডার থেকে পোল্যান্ড বর্ডারের গেট মাত্র চারশ মিটার। ওটুকু পথ পার হতে রাত পেরিয়ে যায়। সকাল ৭টার দিকে আমরা পোল্যান্ড বর্ডারের গেট পার হই। তার ১০-১৫ মিনিটের মাথায় আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। মেডিকেল টিম আমাকে নিয়ে যায়। শুনেছি প্রায় আধাঘণ্টার মতো আমার জ্ঞান ছিল না। সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাসের লোকজন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং আমাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমি বলি আমার মোয়াজকে ছাড়া আমি যাব না।
স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মোয়াজের সঙ্গে শাকিলের দেখা হয় এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের ঠিক করা গাড়িতে তারা পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে পৌঁছান। দূতাবাসের ঠিক করা হোটেলে উঠেছেন। শাকিল জানান, তিনি এখন দেশে ফিরতে চান।