বৈষম্য দূরীকরণ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা

এম আনোয়ার হোসেন | সোমবার , ২৫ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

সমাজে, রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি জায়গায় বৈষম্য বিরাজমান ছিল। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ বৈষম্যে জর্জরিত ছিল। বৈষম্য শব্দের শাব্দিক অর্থ ভেদাভেদ, প্রার্থক্য, অসমতা। দুনিয়ার বুকে অসমতার অনেক করুণ ইতিহাস রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে ন্যালসন ম্যান্ডেলা ছিলেন বর্ণবাদ বৈষম্য নির্মুলের সফল নায়ক। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে বহু বর্ণ ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ন্যালসন ম্যান্ডেলা। এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বৈষম্য ছিল চরম পর্যায়ে। শেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চরম নির্যাতন করত। তাদের এ জাতিগত বৈষম্য গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও নিন্দনীয় ছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু থেকে আমাদের দেশে লিঙ্গ বৈষম্য থেকে শুরু করে জাতিগত বৈষম্যও বিরাজমান ছিল। সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য ছাড়াও শালিসবিচার, চাকরিবাকরি, অফিসআদালতে বৈষম্য লক্ষণীয় ছিল। সেই থেকে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়ে আজ অব্দি চলমান। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকার বিভেদ তৈরি হয়।

এছাড়াও স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতে প্রথম বৈষম্য তৈরী হয় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির বিভক্তি নিয়ে। ফলে সমাজে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেউ বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছে আর কেউ বঞ্চিত হয়েছে। আবার স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মধ্যেও কয়েক ধরনের পক্ষ বিদ্যমান। দেখা গেছে, স্বাধীনতার পরে যাদের জন্ম তাদেরকেও স্বাধীনতার পক্ষেবিপক্ষে বিভক্ত করে কেউ কেউ সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা পেয়েছে আবার কেউ কেউ বঞ্চিত হয়েছে। অথচ সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। সবার সামাজিক ক্ষেত্রে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সমান সুযোগ সুবিধা ভোগ করার কথা। যেহেতু সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী প্রত্যেকে সমান সুযোগ সুবিধার আওতাধীন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরী হওয়ায় রাষ্ট্রের অভিজাত শ্রেণির দাপট ছিল খুবই অপ্রতিরোধ্য। যেমন, ব্যাংকিং সেক্টরে চরম বৈষম্য বিরাজমান ছিল। সেখানে অসহায়, দরিদ্র, ভুমিহীন ও ভুমিহীন কৃষকদের জন্যে কোনো ধরনের ঋণের ব্যবস্থা ছিল না। এ ধরনের আর্থিক বৈষম্য ধনীকে আরো বেশি ধনী করেছে আর গরীব অসহায়কে আরো অসহায়ত্বের দিকে, দারিদ্রতার দিকে নিপতিত করেছে। এ ছাড়াও রাজার ঘরে রাজার আবির্ভাব প্রথার কারণে সমাজে প্রকৃত মেধার অবমূল্যায়ন ঘটে। ফলে টাকা পাচারের মত মেধারও পাচার ঘটে। মেধার মূল্যায়নে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। সঙ্গত কারণে মানুষের চরিত্রে বৈপরীত্যে নিয়ে সমাজ এগিয়ে যায়। নাগরিক অধিকার খর্ব হয়। ভিন্ন মতের মানুষেরা জীবন্ত লাশের মত জীবন অতিবাহিত করে। সমাজে লেজুরভিত্তিক রাজনীতির আবির্ভাব ঘটে। তাতে করে একজন দুর্নীতিবাজ, অদক্ষলোক, জাতিগত বিভেদ সৃষ্টিকারী কিংবা সন্ত্রাসও সমাজের কিংবা দেশের হর্তাকর্তার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়। ফলে নাগরিক অধিকার কিংবা মানবাধিকার অনেক সময় ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এ সব কারণে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র কখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি দেশে দুর্বল জনসমষ্টি, দল, মত, বর্ণের মানুষ নাগরিক অধিকার থেকে এবং ক্ষমতায়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এ সব চলতে থাকলে গণতন্ত্র কখনো আসবে না। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া যাবে না। বরং স্বৈরাচারী মনোভাব, স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয়যন্ত্রের উপরে নয়, মানুষের অস্থিমজ্জায় স্থায়ী আসন করে নিতে পারে। যাতে করে সমাজে, রাষ্ট্রে জোর দখল সংস্কৃতি বিরাজ করবে। ১৯৯১ সাল ও ২০০৮ সালের নির্বাচন ছাড়া এ দেশের মানুষ আর কখনো প্রকৃত অবাধ ও সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন পেয়েছে বলে হয়তো কেউ দাবী করতে পারবে না। ফলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সুশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশে প্রকৃত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ ও অর্থবহ নির্বাচন প্রধান শর্ত। এটা করা না গেলে এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা করা না গেলে সমাজে, দেশে কখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বরং সুশাসন অধরাই থেকে যাবে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে জোর যার মুল্লক তার নীতি অতীতের মত অব্যাহত থাকতে পারে।

দেশে অতীতের ইতিহাসে, বিরোধী দল কিংবা ভিন্ন মতের মানুষের ওপর অত্যাচার হয়েছে, খুন, গুম, আয়নাঘর, নির্যাতননিষ্পেষণ ইত্যাদির মাধ্যমে জুলুম নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার চলেছে। বর্তমানেও যদি সেই ধারা অব্যাহত থাকে তবে নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার অধরাই থেকে যাবে। অতীতের মত বর্তমানেও নির্যাতিত মানুষের হাহাকার বৃদ্ধি ঘটবে। তাদের ক্রন্দনে বাতাস প্রকম্পিত হবে। নাগরিক ও মানবাধিকার খর্ব হবে। মানুষ বিনা বিচারে নিহত হবে। ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতারের প্রথা চালু হতে পারে। এ সব থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। মানুষের নাগরিক অধিকার উন্নয়ন প্রয়োজন। মানবাধিকার উন্নয়ন প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসন বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে রাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রায় সব জায়গায় পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয় বৈষম্য দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একদিনে কিংবা কয়েক মাসে বা বছরে বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব নয়। যেহেতু এ দেশ দুর্নীতির আখড়া। এক সময় দুর্নীতিতে এ দেশে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তাই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বীজ বপন হয়ে আছে। এ দেশের ওপরের কথা কী বলব, ইউপি, ইউনিয়ন ভূমি অফিস খাসমাল, এসিল্যান্ড অফিসে যেখানে অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফাইল নড়ে চড়ে না, সেখানে জেলা, বিভাগ, অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়ে পর্যন্ত কী অবস্থা সেটা নিশ্চয় অজানা নয়। এ সবের স্থায়ী উত্তরণে কাজ করা অতি জরুরি।

আমরা জাতি হিসেবে মানসিকভাবে এমন দৈন্যদশায় ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম যে, কখনো কখনো একজন আন্ডার মেট্রিক লোকও নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত ডিসি, এসপি কিংবা অতিরিক্ত সচিব বা সচিব বলে চালিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে পর্যন্ত ইউএনও, এসিল্যান্ডরা সম্মান দিতে গিয়ে পাগল হয়ে ওঠে। আমরা ঘুষ, দুর্নীতিকে নিজেদের বেশভুষার মত করে তুলেছি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অদ্যবধি একজন সামান্য উচ্চ বিদ্যালয়ের সহ প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিতে অতিরিক্ত টাকা না পেলে নিয়োগ বিলম্বিত হয়। অতীতে বিদ্যালয়ের একজন নাইট গার্ড নিয়োগে পর্যন্ত লক্ষাধিক টাকায় হয়েছে। দলকানারাই এ সব করেছে। এ দিকে জাতীয় নির্বাচনও জরুরি। এই সমস্ত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সমাজের বেকার শ্রেণি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। বাজারের সিন্ডিকেট শক্ত হয়ে ওঠেছে। নিত্য নতুন দাবি নিয়ে শ্লোগান, মিছিল, মিটিং হচ্ছে। কখনো অবরোধের হুংকার দেয়া হয়। যে সমস্ত জায়গায় আগে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হত, সেখানে এখন নতুনদের দখলে চলে গেছে। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী থেকে শুরু করে প্রায় সব জায়গায় অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় গ্রাহকদের চেকের টাকা দিতে না পেরে ব্যাংকারেরা লাঞ্চিত হচ্ছে।

সাধারণত একটি দেশের শান্তি নির্ভর করে আইন শৃঙ্খলার ওপর। আইন শৃঙ্খলার অবনতি মানেই দেশের অবনতি। যেখানে মানুষের নাগরিক অধিকার লোপ পায়। তাই পুলিশকে দ্রুত স্বাভাবিক ও জনপ্রিয় করে গড়ে তুলতে হবে। সেনা বাহিনীর ওপর মানুষের বিশ্বাস অটুট রাখতে হবে। তাদের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। প্রয়োজনে র‌্যাববিজিবিকে পুলিশের সাথে কাজে লাগাতে হবে। আদালতকে ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে স্বাধীন করে গড়ে তুলতে হবে। যেহেতু আদালত মানুষের শেষ ঠিকানা। এই ঠিকানা যেন কখনো দুর্বল না হয়। কিশোর গ্যাং, বেকারত্বের অভিশপ্ত গ্যাং এবং বিভিন্ন সিন্ডিকেট দ্রুত ভেঙে দিন। এ জন্যে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহযোগিতা বৃদ্ধি করুন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা নিশ্চিত করুন। দেশবিদেশে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অবারিত করুন। দেশে দেশে দুর্বল কুটনীতির অভিযোগের জায়গায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। মানুষের হৃদয়ে নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার পুতে দিন। এ জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি নির্দেশনা প্রদান করুন। যেন তারা তাদের মধ্যে নাগরিক ও মানবাধিকার প্রচার ও প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়। দাবী দাওয়া নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে স্মারকলিপি ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার প্রয়াস অব্যাহত থাকতে পারে। রাষ্ট্র দুর্বল, অসুস্থ হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির অন্ত থাকে না। এর থেকে উত্তরণ আজ সময়ের দাবী। দেশ এগিয়ে যাক। অশান্ত ও উদ্বিগ্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি ও স্থিতি আসুক।

লেখক : কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : মহান বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো
পরবর্তী নিবন্ধজীবনব্যাপী শিক্ষা : শিক্ষকও জীবনব্যাপী