বৈষম্যের সমসাময়িকতায় অসহায় কিডনী রোগী

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস | বৃহস্পতিবার , ১৩ মার্চ, ২০২৫ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দিনে দিনে কিডনী রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে জনগণের প্রতি ১০ জনের ১ জন আগামীতে কিডনী বিকল হওয়ার ঝুঁকিতে। এদের ১০ শতাংশের আগামী দশ বছরের মধ্যে কিডনী বিকল হওয়ার আশঙ্কা ন্যূনতম শতকরা ১০ ভাগ ও যার ১০ শতাংশের ডায়ালাইলিসস বা প্রতিস্থাপন লাগবে। ভয়ানক তথ্য। ভাবনার ব্যাপার হলো কিডনীর নিজের খুব কম রোগই আছে। তবে প্রায় সব ধরনের কিডনী ও মূত্রতন্ত্রের রোগ এবং ডায়বেটিস ও উচ্চরক্তচাপের মত অন্যান্য অনেক রোগে শেষ পর্যন্ত কিডনী বিকল হয়। অনুমান করা যায় প্রায় সকলেই তাই কিডনী বিকল রোগের ঝুঁকিতে আছেন। কিডনী রোগের তথা ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। সাধ থাকলেও সাধ্যের বাইরে। তাছাড়া বেশ কাঠখড়ি পুড়িয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত অনেকেই বাধ্য হয়ে চিকিৎসা চালাতে পারেন না। তাই ঘরে ঘরে চলছে নীরব আহাজারী। নিত্যনতুন রোগ নিরুপণী ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সংযোজনে চিকিৎসা ব্যয় দিনে দিনে আকাশচুম্বি হচ্ছে। ব্যয় সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিভিন্ন সমীক্ষা ও জরীপে এবং মতবিনিময়ে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায় যে সমস্যাগুলিতে রোগীরা নিপতিত তা হলো: সময়মত রোগ নির্ণয়ের অসচেতনতা, ডায়ালাইসিসের অপ্রতুলতা, ডায়ালাইসিসের উচ্চমূল্য, পরীক্ষা নিরীক্ষার ও ঔষধ এবং অন্যান্য সামগ্রীর ব্যয়, দক্ষ চিকিৎসা সেবা প্রদানকারীর অভাব, চিকিৎসা সেবা প্রদানকারী সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, যথাযথ তদারকী ও পরিবীক্ষণের অত্যল্পতা, চিকিৎসা সেবায় আরোপিত ভ্যাট ও ট্যাক্স ইত্যাদি।

দু’ভাবে এই বৈষম্যকে বর্ণনা করা যায়: . সুযোগের অভাব ও ২. সামর্থের অভাব। এই অভাবের কারণে বেশির ভাগ কিডনী বিকল রোগী চিকিৎসা পরিত্যাগ করেন বা যেন তেন উপায়ে চিকিৎসা চালিয়ে যান। ফলাফল বা পরিণতি হলো রোগ ভোগের কষ্ট বা অকাল মৃত্যু। এর ফলে এক জন রোগীর সাথে এক একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। চলছে আর্থসামাজিকমানবিক বিপর্যয়ের এক নীরব মহামারী। স্বজন হারানোর কষ্টের সাথে সাথে রচিত হচ্ছে দারিদ্রতা আর টিকে থাকার এক অসম লড়াই। বৈষম্যের শিকার অসহায় কিডনী রোগীর হাহাকার।

দিনে দিনে চিকিৎসা সেবার মানবিকতা পরিবর্তিত হয়ে ব্যবসায়িক অবস্থানে চলে যাচ্ছে। তাই পাঁচতারা হোটেলের মতো হাসপাতাল হচ্ছে যা বেশির ভাগের সাধ্যের বাইরে। অন্য অসাম্যতার পাশাপাশি ব্যয়বহুল চিকিৎসার এই ব্যবস্থা দুর্নীতিরও প্রসার ঘটাচ্ছে। প্রয়োজন এই বৈষম্যের অবসান। তা করতে হলে কিডনী রোগীদের চিকিৎসা পুনর্বাসনকে সমাজায়ন করতে হবে; গোষ্ঠী, ব্যাষ্টি ও সমষ্টির সংঘবদ্ধতায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিশ্বের খ্যাতনামা প্রবক্তা ডা. মরিস কিং তৃতীয় বিশ্বের জন্য সাতটি স্বাস্থ্য সারণী দিয়েছেন। ১. একজনের জন্য সব কিছু নয় সবার জন্য কিছু না কিছু ২. স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে মুনাফাকারী, . ব্যাপকভাবে গভীরতার যথাযথ সমন্নয়, . কম খরচে সর্বোচ্চ গুণগত লাভালাভ, . লাগসই প্রযুক্তি, . গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণকারী বানানো এবং ৭. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবাকে জনারণ্যে নিয়ে যাওয়া।

আশু রোগ সনাক্তকরনেই কিডনী সুরক্ষা এই প্রতিপাদ্য’ নিয়ে ২০২৫ এর বিশ্ব কিডনী দিবসে আলোচনা, সেমিনার, টকশো ইত্যাদি জনগণের কতটুকু উপকারে বা সমস্যা সমাধানে আসে জানি না। এখানে আমরা পরষ্পর নিজেদের জ্ঞানের পরিসঞ্চালন করে হয়ত তৃপ্তি পাবো কিন্তু কতটুকু ফলপ্রসূ তা ভেবে দেখতে হবে।

এধরনের মিথষ্ক্রিয়া এবং তথ্য পরিসঞ্চালন করতে হবে অংশীজনদের নিয়ে যারা জনস্বার্ধে জনকল্যাণে পরিবর্তন আনতে পারার কর্তৃত্ব ধারণ করেন। ক্ষমতা, অর্থ, শক্তি আর সংযোগের সহযোগী হবে কিডনী রোগী। তা দিয়ে গতিশীল সামাজিক তোলপাড় ও শোরগোলের মাধ্যমে। যেমন করেছিলেন একজন কিডনী বিকল রোগী সেফ গ্লেজার। শুরু করেছিলেন সামাজিক আন্দোলন। ডায়ালাইসিস রত অবস্থায় মেশিন সহ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ঢুকে পড়ে তার বক্তব্য দিয়েছিলেন। ফলাফল যুক্তরাস্ট্রের কিডনী রোগীর অধিকার আইন। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র চিকিৎসা যার ব্যয় সরকার বহন করে। ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন। আরেকজন আইনজীবী উইলিয়াম ব্রেভারবিজ যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে উপলদ্ধি করাতে পেরে চালু করেছিলেন বিশ্বখ্যাত বৃটিশ এনএইচএস। আমরা নেফ্রোলজিস্টরা অংশীজনদের নিয়ে এই ধরনের তোলপাড় সামাজিক আন্দোলন করতে পারি তবেই তা হবে কিডনী দিবস পালনের আসল সার্থকতা। শোরগোল তোলা। যা হবে পেশা, বিজ্ঞান, জনগণ সবার জন্য কল্যাণকর। হবে সোশ্যাল বিজনেসের আরেক প্রয়োগ। বৈষম্যের অবসান। এর অন্যথা হবে কথার ফুলঝুরি।

লেখক: ইন্টারনিস্ট ও নেফ্রোলজিস্ট, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান নেফ্রোলজী ও প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিসিএসে গণিত বাদ দেওয়ার সুপারিশ ও আমাদের ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধপদযাত্রা থেকে হামলা, ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা পুলিশের