যাকাতের মূল উদ্দেশ্য দারিদ্র বিমোচন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ কমানো ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ, জনগণকে অভাবমুক্ত, সচ্ছল বানানোর মাধ্যমে দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যাকাত এর ভূমিকা অপরিসীম। অভাব দূর হলে অপরাধের মাত্রাও কমে যায়। পবিত্র কোরআন মজিদের ৮২ জায়গায় নামাজ ও ৩২ জায়গায় যাকাত, আবার ২৭ জায়গায় নামাজ ও যাকাতের কথা একত্রে বলা হয়েছে। এর থেকে বুঝা যায় যাকাত সচ্ছল মুসলমানদের জন্য কতো বড়ো এবাদত। ঈমান ও নামাজের মতো যাকাতের দাওয়াত দেয়াও মুসলমানদের ঈমানী কর্তব্য। যাকাত দিয়ে বিশাল তহবিল গঠন করে ব্যাপক আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানো যায়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের মূল মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা। কোরানের নির্দেশ – তাদেরকে দাও আল্লাহর সম্পদ থেকে, যে সম্পদ তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। (আন নূর –৩৩)। ইসলাম সম্পদ অর্জনকে নিরুৎসাহিত করেনি। সম্পদকে বলা হয়েছে জীবনের শোভা। সম্পদ ও সন্তান দুনিয়ার জীবনের শোভা ও সৌন্দর্য্য। (আল কাহফ : ৪৬)। সম্পদ আল্লাহর অনুগ্রহ। তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। (আল জুমাহ : ১০)। নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে উপার্জনের বা সঞ্চিত অর্থের অংশ থেকে যাকাত আদায় এর তাগেদা রয়েছে। এখানে দরিদ্রের অংশ রয়েছে, যা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। মুত্তাকিরা সুসময়ে ও দুঃসময়ে খরচ করে। (আল ইমরান ১৩৩, ১৩৪)। সম্পদের উপার্জন হতে হবে হালাল ও বৈধভাবে। খরচও হবে বৈধ পদ্ধতিতে। অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ভক্ষণ করো না, (আল বাকারাহ ১৮৮)। খাও, পান করো, অপচয় করো না, নিশ্চয় অপচয় কারীদের তিনি পছন্দ করেন না। (আল আরাফ : ৩৯)।
আর্থ সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা: আর্থিক উন্নয়ন অর্থ হলো আর্থিক সমৃদ্ধি। যাকাতের মাধ্যমে আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে। আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়াতায়ালা বলেন, তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাকো আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তা বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত। তিনি আরো বলেন, শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্রতার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রথম আয়াতে সরাসরি বলা হয়েছে যারা যাকাত দেয় তারা বহুগুণ সম্পদ প্রাপ্ত। দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে শয়তান অভাব–অনটনের প্রতিশ্রুতি তথা ভয় দেখায়। আর আল্লাহ ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহর অনুগ্রহ মানে সম্পদে বরকত তথা বৃদ্ধি। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ সম্পদ বাড়বে, এটি আল্লাহর ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি। আমরা মুমিন হিসাবে আমাদের রবের এ প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাসী। বিশ্বাস যখন বাস্তবতার সাথে মিলে যায়, তখন সে বিশ্বাসে থাকে প্রশান্তি। বাস্তবতা হলো যাকাত ফরয হওয়া ব্যক্তিরা যথাযথভাবে যাকাত দিলে যাকাত পাওয়া লোকদের ক্রয় ক্ষমতা বেড়ে যায়। চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করার জন্য তারা বাজার মুখী হয়। বাজারের বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী যাকাত দাতা ধনীরা তাদের পণ্যের উৎপাদন বাড়ায়। বিক্রির পণ্য থেকে তারা লাভ করে এভাবে তাদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ে। অপর দিকে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অধিক জনবল প্রয়োজন হয়। এ প্রয়োজন মিটে যাকাত গ্রহীতাদের মধ্য থেকে। কাজের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় তাদের উপার্জন। যাকাত পেয়ে অভাবী ও দরিদ্রদের আর্থিক সচ্ছলতা আসে আবার উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতের মাধ্যমে যাকাত দাতারা অধিক অর্থের মালিক হয়। এভাবেই যাকাত আর্থিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখে। সামাজিক উন্নয়ন হলো সমাজের আর্থিক উন্নয়ন আর সমাজের লোকদের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন। যাকাতের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন কীভাবে হয় এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে দুটি বিষয়কে সামনে রাখা প্রয়োজন। একটি হলো যাকাতের ৭টি খাত। আরেকটি হলো আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যাকাত হলো ইসলামের সেতু।‘এটা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী করে ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আস্থা ভিত্তিক এক সমৃদ্ধ উন্নত সমাজ গড়ে ওঠে। এতে দূর হয় ধনী দরিদ্রের অস্বাভাবিক বৈষম্য।
আমাদের দেশে একই ব্যক্তিকে আয়কর, সারচার্জ, ভ্যাট, ভূমিকর, উৎসকর, হোল্ডিং ট্যাক্স ইত্যাদি নানা কর দিতে হয়। তার উপর সচ্ছল মুসলমানদেরও সঞ্চিত অর্থে আড়াই শতাংশ যাকাত ফরজ। যা কিছু শাড়ি লুঙ্গী দিয়ে আমরা আদায় করি। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের থেকে যাকাত এবং অমুসলিমদের থেকে জিজিয়া আদায় করা হলে একই ব্যক্তিকে একাধিক বার কর দিতে হতো না। কারণ যে পরিমাণ বৎসরে যাকাত আদায় হতো তা দিয়ে পুরো দেশের বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সম্ভব হতো। যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যাকাত দরিদ্রের প্রতি অনুগ্রহ নয়। এটি তার অধিকার। উপার্জন অক্ষম, দুস্থ, অভাবগ্রস্ত, অন্ন–বস্ত্র ও আবাসনের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে। রাষ্ট্র যাকাত ও ওশর (ফসলের যাকাত) আদায় করে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে পারে। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও বিতরণ হলে যাকাত প্রদানকারী জানবে না কে যাকাত নিচ্ছে। গ্রহণকারী জানবে না তার কাছে কার যাকাত আসছে। ব্যক্তিগতভাবে যাকাত না দিয়ে সমষ্টিগতভাবে যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্রতা বিমোচন কর্মসূচী হাতে নেয়া দরকার। গরীব আত্মীয় স্বজনকেও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যাকাত দেয়া যায়। দরিদ্র আত্মীয় স্বজনকে যাকাতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার হলেও পিতা–মাতা ও তদুর্ধ্ব এবং পুত্র কণ্যাকে যাকাত দেয়া যাবে না। কেননা তাদের ভরন পোষণ সন্তান ও পিতা–মাতার দায়িত্ব, সম্প্রতি ধর্ম উপদেষ্টা প্রফেসর ড. আ.ফ.ম. খালিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা যাকাত আদায় করা সম্ভব। এতে দশ বছরের মধ্যে এদেশে ভিক্ষা করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলা যায়, আসুন যাকাত ও সাদাকার মাধ্যমে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের শোকর আদায় করি। এতেই অর্জিত হবে আর্থ সামাজিক সমৃদ্ধি, দূর হবে সকল প্রকার বৈষম্য।
লেখক : আইনজীবী, সিনিয়র সহ–সভাপতি, কিডনি রোগী কল্যাণ সংস্থা, আজীবন সদস্য, মা ও শিশু হাসপাতাল, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা ও সাধারণ সম্পাদক, জায়তুন–য়্যাহয়্যা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট।