বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির পর সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশকে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ‘দুর্নীতি’ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নগরের কয়েক জায়গায় ‘ইচ্ছেকৃতভাবে’ সড়কবাতি বন্ধ রাখার অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার এ বিষয়ে পৃথক দুটি অফিস আদেশ জারি করেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। একইসঙ্গে চসিক মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী হোসেন আওরঙ্গজেব গত মঙ্গলবার যে অব্যাহতি পত্র দেন তা গতকাল গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা গতকাল বিকেলে টাইগারপাস চসিকের প্রধান কার্যালয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে উপস্থিত হন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমী।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা চসিকের বিভিন্ন কর্মকর্তা–কর্মচারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। তাদের দাবি, ঝুলন কুমার দাশের নির্দেশে সরকার পতনের আন্দোলন চলাকালে গত ৩ থেকে ৫ আগস্ট শহরের সব সড়ক বাতি বন্ধ রাখা হয়। সড়ক বাতি বন্ধ করে রাতের আঁধারে ছাত্র–জনতার ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার–নির্যাতন চালানো হয়। গুলিবর্ষণও করা হয়। এতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তাই ঝুলন কুমার দাশকে বরখাস্ত করার দাবি জানায় তারা। এসময় সিটি মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী হোসেন আওরঙ্গজেব আন্দোলন দমানোর জন্য ছাত্রলীগকে টাকা ও অস্ত্র দিয়েছেন দাবি করা হয়। এ জন্য তাকে চাকরিচ্যুত করারও দাবি করা হয়। ছাত্ররা জানান, বহদ্দারহাটে মেয়রের বাড়ির সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী নিহত হয়েছেন।
এসময় ছাত্ররা প্রধান নির্বাহীকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তাদের নামে আগেও অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেননি কেন? তখন প্রধান নির্বাহী বলেন, সেগুলো প্রক্রিয়াধীন। ছাত্ররা উপ–প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মোরশেদুল ইসলাম চৌধুরী, মেয়রের ব্যক্তিগত সহকারী দুলাল, চসিক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, চসিকের দামপাড়া অফিস (বিদ্যুৎ) এর সুপারভাইজার জাহেদ, স্টাফ অফিসার মো. মামুন, স্টেট শাখার দিদার এর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে বলে জানান।
এছাড়া আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ও প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লতিফুল হক কাজমীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন সমন্বয়কেরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদ চসিকের প্রধান প্রকৌশলীর পদোন্নতি যথাযথভাবে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন। এ জন্য প্রধান প্রকৌশলীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বলেন এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকেও পদত্যাগ করতে বলেন। এই নিয়ে দুই পক্ষের বাদানুবাদের এক পর্যায়ে শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ও লতিফুল হক কাজমী অফিস ছেড়ে যাওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়ান। তারা সমন্বয়কদের কর্পোরেশনের বিধি বিধান এবং অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে ছাত্ররা কারও ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন করছেন কি না সংশয় প্রকাশ করেন দুই কর্মকর্তা। তখন সেখানে উপস্থিত সমন্বয়ক রাসেল–এর মোবাইল ফোন চেক করার কথা বলেন প্রধান নির্বাহী। পরে অন্য সমন্বয়করা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণণে আনেন। এসময় প্রধান নির্বাহী জানান, তিনি কোনো ধরনের অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ছুটি নিয়ে দেশের বাইরে ছিলেন। তাই সড়ক বাতি বন্ধ রাখার বিষয়ের সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত নন।
অতঃপর বরখাস্ত ও তদন্ত কমিটি : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ঝুলন কুমার দাশকে সাময়িক বরখাস্ত করে অফিস আদেশ জারি করেন। এতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এবং তা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
এদিকে গঠিত তদন্ত কমিটিতে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা কমান্ডার লফিফুল হক কাজমীকে আহ্বায়ক এবং আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিমকে সদস্য সচিব করা হয়। সদস্য করা হয়েছে আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিনকে। কমিটি গঠন বিষয়ে অফিস আদেশে বলা হয়, ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের ৩–৫ আগস্ট নগরের কয়েকটি জায়গায় ইচ্ছাকৃতভাবে আলোকায়ন বন্ধ রেখে অনিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টির অভিযোগ এবং বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জরুরি তদন্ত করবে। ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
সামগ্রিক ঘটনার বিষয়ে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ চসিক কার্যালয়ে এসে প্রাথমিকভাবে ২টি দাবি করেন। তারা জানান, ৩ আগস্ট থেকে ৫ আগস্ট ঝুলন কুমার দাশের নির্দেশনায় নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে সড়কবাতি নেভানো ছিল, যার ফলে আন্দোলনরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা নিরাপত্তাহীনতার শিকার হন। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্রবৃন্দ ঝুলন কুমার দাশের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন দুর্নীতির প্রকাশিত সংবাদ উপস্থাপন করেন। তারা দুপুর ৩টা থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যে ঝুলন কুমার দাশকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা না হলে সংবাদ সম্মেলন করে তার বিভিন্ন দুর্নীতির তথ্য গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, মেয়র মহোদয়ের একান্ত সহকারী হোসেন আওরঙ্গজেব শিবলু মঙ্গলবার চাকরি থেকে অব্যাহতির যে আবেদন করেছে তা গ্রহণ করা হয়েছে। ছাত্ররা লিখিতভাবে আরো কিছু দাবি জানিয়েছে সেগুলোও আমরা গ্রহণ করেছি।