আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এ বছরের স্লোগান হচ্ছে…..”বৈশ্বিক মহামারীর বার্তা, প্রবীণদের সেবায় নতুন মাত্রা“। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১কোটি ৪০ লক্ষ প্রবীণ রয়েছে যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে এ জনসংখ্যা ছিল ৫.৭ শতাংশ যা ২০৫০ সালে শতকরা প্রায় ২০ ভাগে উন্নীত হয়ে ৪কোটি ৩০ লক্ষ্যে পৌঁছবে । ২০৩১ সালের দিকে বাংলাদেশের জনমিতিক সুবিধা শেষ হবার পর প্রবীণ জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকবে। প্রবীণদের দারিদ্র্যমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত কল্পে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ২০১৩’ এবং “পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩” প্রণীত হলেও তাঁদের বাস্তব অবস্থারতেমন কোন উন্নতি হয়নি । বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস জাতীয়রোগে ইউরোপ ও জাপানে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের প্রায় ৯৫ শতাংশের বয়স ৬০ বৎসরের বেশী, ৫০ শতাংশের বয়স ৮০ বৎসর বা তার বেশী । বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু সংক্রান্ত সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষিত না থাকলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবীণ ব্যক্তি ইতোমধ্যেই করোনায় পরলোক গমন করেছেন।
বৈশ্বিক মহামারী দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রবীণদের জন্য প্রতিরোধমূলক ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারীর সময় তাঁদের যথাযথ সুরক্ষা এবং সহয়তা প্রদান করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য । বৃদ্ধ পিতামাতার প্রতি বিরক্তিসূচক “উহ্” শব্দটিও উচ্চারণ না করার ব্যাপারে পবিত্রকোরানের সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং তাঁদের যথাযথ ভরণপোষণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে বিদ্যমান আইনে কারা/ অর্থ দণ্ডের বিধান থাকলেও বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ নিজেদের সন্তান–সন্ততি কর্তৃক প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন । পিতা–মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্যকোথাও পাঠানো যাবে না মর্মে আইনের বিধানটিও লংঙ্ঘিত হচ্ছে । ভারতের ১০কোটি প্রবীণের মধ্যে প্রায় ৯কোটিকে এখনো তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্যকোন নাকোন ধরনের কায়িক পরিশ্রম করতে হয় । সাড়ে পাঁচ কোটি ভারতীয় প্রবীণকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় নিদ্রায়যেতে হয় । তাঁদের প্রায় অর্ধেকে কোন নাকোন প্রকারের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অথচ “ভারতীয় জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা, ১৯৯৯” এবং “পিতা–মাতা ও সিনিয়র নাগরিকদের ভরণ–পোষণ এবং কল্যাণ আইন,২০০৭” এর শাস্তির বিধান যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না । প্রতি বৎসর প্রায় ২১ লক্ষ মার্কিন প্রবীণ নানা ধরনের উপেক্ষা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ।
২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ১৫৯টিদেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিকঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সিদ্ধান্তনেয়া হয়যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার,মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’
এই সম্মেলনেযে এগারোটি বিষয়ের ওপর গূরুত্ব আরোপ করা হয়সেগুলো হচ্ছে (১) সকল প্রবীণ নাগরিকেরমৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন, (২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসঙ্ঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন, (৩) নিজেদের সমাজেস্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন, (৪) জীবনব্যাপি এবংশেষ জীবনেও সছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে (৫) প্রবীণরাকোনও একক সমজাতীয় বর্গ নয় বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপি শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ, (৬) প্রবীণরাযেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে, (৭)জেন্ডারকেন্দ্রীক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যেজেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার; (৮) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত:প্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান, (৯) প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা (১০) প্রবীণদের মধ্যে প্রাইভেটসেক্টর, সিভিলসোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়েতোলার সহযোগিতা, (১১) উন্নয়নশীলদেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলোকেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান।
এই সম্মেলনেযে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো : (ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন, (খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি; (গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ নিজ পরিবারেই তাঁদের সম্মান ও ক্ষমতা হারাচ্ছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের দারিদ্র বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদের ধারণা।সেক্ষেত্রে অস্বচ্ছল ও রোগাক্রান্ত প্রবীণেরা মারাত্মক অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন। তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্রমুক্ত, কর্মময় সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং অন্যান্য নীতিমালা (স্বাস্থ্যনীতি, গৃহায়ন, নারী উন্নয়ন, প্রতিবন্ধি নীতি) সমূহের বাস্তবায়ন এবং যানবাহন, আবাসন ও অন্যান্য সকলভৌত অবকাঠামোর প্রবীণবান্ধব করণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। করোনা মহামারীরোধে স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে সরকারঘোষিত আর্থিক সহায়তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবীণদের চিকিৎসা ও কল্যাণে ব্যয় করতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে অন্ততঃ ৭০ বৎসর বা তদুর্দ্ধ বয়সী নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন অপ্রদায়কপেনশন (ঁহরাবৎংধষ হড়হ–পড়হঃৎরনঁঃড়ৎু ঢ়বহংরড়হ) তহবিল গঠন করলে সরকারের সামাজিক সুরক্ষা খাতথেকেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রদান করা সম্ভবপর হবে। বিশ্বের প্রায় ১০০দেশে এধরণের তহবিল আছে। অস্বচ্ছল প্রবীণদের ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ সক্ষম প্রবীণদের উপযুক্ত ঋণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরী। করোনায় আক্রান্ত ও নিহত প্রবীণদের ধর্মীয় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতকল্পে পত্রিকা/টেলিভিশন ও সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন । প্রবীণ কল্যাণের লক্ষ্যে বিশেষ তহবিল গঠন করে তাতে বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা ফান্ড –এর অর্থ জমাদেয়ার নির্দেশদেয়া যায়। ব্যক্তিগতভাবে এ ফান্ডেকেউ অর্থ প্রদান করলে তা করমুক্ত রাখার ব্যবস্থা করা উচিৎ।
বর্তমান করোনাকালে প্রবীণদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। বাংলাদেশকে একটি প্রবীণহিতৈষীদেশ হিসেবেদেখতে চাই। সকল সময়েই প্রবীণদের প্রতিকোনো বৈষম্য নয় বরং সমাজে তাদের সম্মান নিশ্চিত রাখতে হবে। তাদের বিনোদন ও শরীরচর্চার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রবীণদের দায় হিসাবে মনে না করেদেশের জন্য মূল্যবান রিসোর্স হিসাবে ভাবতে হবে। তাদেরকে সঠিক ভাবে কাজে লাগাতে পারলে দ্বিতীয় জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে। তবে এ কথা ঠিকযে, বৈশ্বিক পরিমন্ডলে সর্বত্রই ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদে জীবনাচরণে পরিবর্তন এসেছে ু পরিবার কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে। যৌথ বা বর্ধিত পরিবারের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে অনু পরিবার। গ্রাম–শহরে উভয় জায়গাতেই বয়স্ক ব্যক্তিদেরক্ষেত্রে পরিবারভিত্তিক সাপোর্টযেন কমে এসেছে। সন্তানহীন বয়স্ক মানুষদের চাহিদার ভিত্তিতে বিশেষ বাসস্থান বাহোমস প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুকরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা আলাদা করে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে স্বতন্ত্রজেরিয়াট্রিককেয়ার এবং বাড়ি বাড়ি ভিত্তিকসেবা প্রদানের বিষয়টিদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় সঠিক স্থানে রাখতে হবে। এক কথায় বাড়ন্ত এ বয়স্ক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি,পেনশন ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে তাদের সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, মর্যাদাদেয়া ও সহায়তা করা আমাদের কর্তব্য হ্ওয়া উচিৎ। প্রবীণরা অভিজ্ঞতার সম্পদ, আমাদের কাছে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে চলমান ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ, চট্টগ্রাম বিভাগীয় শাখা।