সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের সকলকেই একটা বিষয় বেশ ভাবিয়ে তুলছে তা হলো দিন দিন নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির যুগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নিত্য নতুন আবিষ্কার আমাদের জীবনকে করে দিচ্ছে সহজ থেকে সহজতর। বিজ্ঞান শুধু দূরকেই কাছে করেনি, আমাদের পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মঙ্গল গ্রহেও পৌঁছে গেছে। তারপরও আমরা মানুষরা কোথায় যেন একটা শূন্যতা অনুভব করছি। হয়তো মানুষ বলেই বিষয়টি আমাদের মনে কাজ করে। সেই শূন্যতাটি হলো মনের প্রশান্তি। মানুষ শান্তির জন্য কত কিছুই না করছে (যুদ্ধ, মারামারি, হানাহানি, চুক্তি)। তারপরও কি শান্তির দেখা পাচ্ছে? আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, সহিংসতা দিয়ে সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না, প্রেম দিয়েই সহিংসতার সাথে লড়াই করা যায়। তার উপর আছে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উৎকর্ষতার ভিড়ে আমরা যেন নৈতিকতা, মানবিকতা, সততা, মূল্যবোধ,আত্মিক শুদ্ধতা, সৃষ্টির প্রতি কল্যাণ ইত্যাদি বিষয়গুলো হারিয়ে ফেলছি। তাই এইগুলো টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন সুফিবাদের চর্চা। তাই বলে সমাজে সবাইকে সুফি হতে হবে বিষয়টি কিন্তু তা নয়। আর সমাজের সকলের পক্ষে সুফি হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু জীবনবোধের মূলে সুফি বা আধ্যাত্মিক আদর্শ থাকা প্রয়োজন। না হয় মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে উঠা কঠিন। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে নিজেকে এবং নিজের আত্মাকে কলুষমুক্ত রাখাই সবচেয়ে বড় কাজ। একজন আধুনিক চিন্তাচর্চার আধ্যাত্মিক ও সুফিবাদী গুরু হলেন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ)। সাহিত্য, দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, জীবনবোধে, সমস্ত ক্ষেত্রেই ছিল যাঁর আশ্চর্য বিচরণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক তরুণ প্রজন্মের মাঝে রুমির প্রতি ঝোঁক দেখা যায় প্রেম ও মানবতার আহবানের জন্য। ইউরোপের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ‘রুমি’ পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত আছে।
আমাদের এই নৈতিক মূল্যবোধের সংকটময় মুহূর্তটি কাটিয়ে তোলা সম্ভব সুফিদের জীবনাদর্শ চর্চার মাধ্যমে। সমাজে ভোগবাদী প্রবাহকে থামাতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানের সাথে সুফিবাদী শিক্ষা বা আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয়। স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে নিয়ে রুমির দর্শন আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিতে পারে। মহাত্মা গান্ধী রুমির দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘পৃথিবীতে যা কিছু আছে সেটা প্রত্যেকের প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু প্রত্যেকের লোভের জন্য নয়’। স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে নিয়ে রুমির দর্শন আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে দিতে পারে। এই একুশ শতকে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে উদার ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি হিসেবে। সুফিবাদী শিক্ষা বা আধ্যাত্মিক শিক্ষাকে যদি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা যেত তাহলে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন উদার ও বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্বজনীন নাগরিক গড়ে তোলা সহজ হতো।