ওয়ান হেলথ বা এক স্বাস্থ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বব্যাপী একটি গুরত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওয়ান হেলথকে একটি কার্যকরী পদ্ধতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে যা বিভিন্ন সেক্টরের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি, নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন এবং গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নত অবস্থান নিশ্চিত করবে।
এক স্বাস্থ্য পদ্ধতিতে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই পদ্ধতি উদীয়মান (ইমার্জিং) ও পুন:উদীয়মান (রি–ইমার্জিং), প্রাণী ও পতঙ্গবাহিত রোগ, খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন ও এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্সের মতো বিভিন্ন ঝুঁকি মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবিলায় এক স্বাস্থ্য পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ।
গবেষণা বলছে–মানুষ, প্রাণী এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। জলবায়ু, ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন, বিশ্বায়ন এবং বন্যপ্রাণী বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কারণ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বৃদ্ধিতে সুযোগ সৃষ্টি করছে, যা প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে সংক্রমণের তীব্রতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি করছে। তবে শুধু মানুষই নয়, এই ঝুঁকি প্রাণীর ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। যদিও আমরা ঝুঁকি মূল্যায়নে প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে জীবাণু সংক্রমণের উপর অধিক আলোকপাত করি, তবে এইসব জীবাণু মানুষ থেকে প্রাণীর মধ্যেও ছড়াতে পারে যা গৃহপালিত বা বন্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এই বৈশ্বিক সমস্যার সমাধান ও প্রতিরোধ কখনই এককভাবে সম্ভব নয়। সম্ভব কেবল প্রাণী, মানব, উদ্ভিদ, পরিবেশ এবং সংশ্লিষ্ট সকল স্বাস্থ্যখাতের পূর্ণ ও সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউওএএইচ) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিএইচও) চারটি সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও বাস্তুতন্ত্রের সমন্বিত স্থানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করে। চারটি সংস্থার কৌশলগত এই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে ‘কোওয়াড্রিপার্টাইট ওয়ান হেলথ উদ্যোগ’। এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে মহামারী (এপিডেমিক) ও অতিমারী (পেন্ডেমিক) প্রতিরোধ এবং এক স্বাস্থ্য পদ্ধতির মাধ্যমে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ ২০২২–২০২৬ সালের জন্য একটি ওয়ান হেলথ যৌথ কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এই কর্ম পরিকল্পনার ছয়টি কার্যকলাপ–এর মধ্যে রয়েছে– ১. স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য ওয়ান হেলথ সক্ষমতা উন্নয়ন, ২. উদীয়মান (ইমার্জিং) ও পুন:উদীয়মান (রি–ইমার্জিং) প্রাণিজ মহামারী ও অতিমারী ঝুঁকি কমানো, ৩. প্রাণিজ, অবহেলিত ক্রান্তীয় ও পতঙ্গবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলকরণ, ৪. খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি মূল্যায়ন, ব্যবস্থাপনা ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ, ৫. এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স (যাকে নীরব অতিমারী বা সাইলেন্ট পেন্ডেমিক বলা হচ্ছে) নিয়ন্ত্রণ ও ৬. পরিবেশকে ওয়ান হেলথ এর সাথে সমন্বয়করণ।
প্রতিবছর ০৩ নভেম্বর ‘বিশ্ব ওয়ান হেলথ দিবস’ পালিত হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ০৩ নভেম্বর বিশ্ব ওয়ান হেলথ দিবস, ২০২৪–এর প্রতিপাদ্য ছিল এক স্বাস্থ্য জোরদারকরণের মাধ্যমে এক স্বাস্থ্য ঝুঁকি মোকাবিলা করা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন বৈশ্বিক ঝুঁকি মোকাবিলায় ওয়ান হেলথ পদ্ধতির কার্যকরী উদ্যোগ দেখা গিয়েছে। তন্মধ্যে কোভিড–১৯, বার্ডফ্লু, ডেঙ্গু, এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স উল্লেখযোগ্য। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত বার্ডফ্লু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে একটি মহাগুরুত্বপূর্ণ জুনোটিক রোগ।
চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু) এবং অন্যান্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত ‘ওয়ান হেলথ পোল্ট্রি হাব’ প্রকল্পটি ওয়ান হেলথ ধারণায় এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল এর ব্যবহার, এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স অনুসন্ধান এবং এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে কার্যকরী গবেষণা পরিচালনা করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পেয়েছে।
বর্তমানে ডেঙ্গু বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক বিস্তৃত মশাবাহিত রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, ডেঙ্গু বর্তমানে ১২৮টি দেশে স্থানীয় রোগ হিসেবে বিদ্যমান। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালের ১লা জানুয়ারি হতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৬১,৮১৭টি ডেঙ্গু জ্বরের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে এবং এরমধ্যে প্রাণহানি ঘটেছে ২৯৭ জনের। ডেঙ্গু জ্বর মূলত এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট, যা ক্রমে এর ভৌগলিক বিস্তার বৃদ্ধি করে চলেছে। এর পেছনে যে কারণগুলো রয়েছে তা হল– নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন, অপর্যাপ্ত বাহক তথা ভেক্টর (মশা) নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, জনগণের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব এবং ভাইরাসের ধারাবাহিক বিবর্তন। ওয়ান হেলথ পদ্ধতি ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটি মানুষ এবং মশার ভেক্টরগুলোর সিস্টেম পর্যবেক্ষণ করে সম্ভাব্য রিজার্ভায়ার এর উপর গবেষণাকে প্রাধান্য দেয় যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পেশাদার এবং গবেষকদের সহযোগিতার মূল কাঠামো হিসেবে পরিচালিত হয়। এছাড়া কার্যকারী ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, প্রতিরোধমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ, টিকা গবেষণা এবং চলমান মহামারী পর্যবেক্ষণ এই জটিল স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং স্বাস্থ্যগত প্রভাব কমাতে ওয়ান হেলথ অপরিহার্য।
২০২০ সালের কোভিড–১৯ মহামারী ও অতিমারী ওয়ান হেলথ পদ্ধতিকে বিশ্বজুড়ে আরো শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট করেছে। বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বিশেষ করে কোভিড–১৯ এর ক্ষেত্রে ওয়ান হেলথ উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনতে পারে। প্রথমত মানুষ এবং প্রাণী উভয় ক্ষেত্রেই সংক্রামক রোগের উপস্থিতি নিরীক্ষণ এবং যাদের মাঝে একই ধরনের জিনোম রয়েছে সেগুলো সনাক্তকরণ এবং সেই সংক্রমণগুলোর স্থান এবং সময়ের বিস্তার নির্ধারণ করতে পারে। এই তথ্য মাঠ পর্যায়ে জনস্বাস্থ্য ও প্রাণীস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সংক্রামক ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় সহায়ক হতে পারে। দ্বিতীয়ত: ওয়ান হেলথ পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে জড়িত স্টকহোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয় এবং সক্রিয় সহযোগিতা সম্ভব, তৃতীয়ত: ওয়ান হেলথ পদ্ধতি সংক্রমণ সংক্রান্ত সংস্থাগুলো কার্যকরী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে যা প্রাণী এবং মানুষের মধ্যে সংক্রমণক্ষম এজেন্টগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থান যেমন জীবন্ত পাখির বাজার (হাঁস মুরগির বাজার, পোষা পাখির বাজার ইত্যাদি) সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, চতুর্থত: ওয়ান হেলথ চিন্তাধারা বিভিন্ন রোগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও সমাধানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।
বৈশ্বিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স। এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মানব, প্রাণী ও পরিবেশখাতে এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল এর ব্যবহার ও অপব্যবহার এবং তার ফলে সৃষ্ট প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার বিশ্বজুড়ে বিস্তার। মানুষের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য ব্যবহৃত বেশিরভাগ এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল প্রাণী এবং মাছের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। ফলে এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে মানব, প্রাণী এবং পরিবেশগত গুরুত্ব ও পরস্পর নির্ভরতা বিবেচনা করে এই সমস্যার সমাধানে উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এরমধ্যে এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল এর অপব্যবহার বন্ধ এবং সংক্রমণের বিস্তার সীমিত করার মাধ্যমে বিদ্যমান এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল এর কার্যকারিতা সংরক্ষণের পদক্ষেপ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। প্রাণী স্বাস্থ্য এবং কৃষি খাতে বড় সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোসপোরিন, ফ্লোরকুইনলনের মাধ্যমে ব্যাপক চিকিৎসা এবং টেট্রাসাইক্লিন ও মাইক্রোলিডের মতো মানব চিকিৎসা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এন্টিমাইক্রোবিয়্যালের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্স বৃদ্ধি পাওয়া। তাই মানব স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ এন্টিমাইক্রোবিয়্যালের অতিরিক্ত ব্যবহার কমানো, স্বাস্থ্যবিধি উন্নয়ন এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। পর্যাপ্ত শিল্প, আবাসিক এবং কৃষি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে সৃষ্ট দূষণের ফলে পরিবেশে রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর সম্প্রসারণ বাড়ছে। ওয়ান হেলথ পোল্ট্রি হাব–এর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে পোল্ট্রিতে ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক এর মধ্যে ৮০–৯০ শতাংশ কমবেশি অকার্যকর হয়ে গিয়েছে; যার মধ্যে মানুষের বিভিন্ন রোগে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ এন্টিবায়োটিকসমূহ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশ এবং বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের এন্টিমাইক্রোবিয়্যাল প্রতিরোধ মোকাবিলায় কর্মপরিকল্পনার মধ্যে ওয়ান হেলথকে অন্তর্ভূক্ত করেছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে– এন্টিমাইক্রোবিয়্যালের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিমালা উন্নয়ন নজরদারি (সার্ভিল্যান্স), ব্যবহার সীমিতকরণ, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন, প্রাণী পালনে এন্টিমাইক্রোবিয়্যালের বিকল্প ব্যবহার। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্য উৎপাদনকারী প্রাণীতে (ফুড এনিম্যালস) নিয়মিতভাবে এন্টিমাইক্রোবিয়্যালের ব্যবহার বন্ধের সুপারিশ করে আসছে। পরিশেষে বলা যায়, ওয়ান হেলথ বা এক স্বাস্থ্য শুধুমাত্র একটি ধারণা নয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেকাংশে মোকাবিলা করা সম্ভব।
লেখক : অধ্যাপক ড. মো: আহসানুল হক : পরিচালক, ওয়ান হেল্থ ইনস্টিটিউট, সিভাসু ও ডা. সালমা চৌধুরী : প্রভাষক, বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ, সিভাসু