সামপ্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কঠিন সময় পার করলেও মন্দাসহ নানা সংকটে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ বিগত দুই দশকেরও অধিক সময়ব্যাপী অর্থনীতির ক্রমবর্ধিত অগ্রগতি দেশকে একটি মৌল ভিত্তির ওপর দাঁড় করেছে। বিশেষ করে কৃষি ও শিল্পোৎপাদন, সার্ভিস সেক্টরের বিস্তৃতি এবং জনগণের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ফলে খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষাবস্থার সম্ভাবনা কম। তাঁদের মতে, এ মুহূর্তে আমাদের বড় সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে–মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতাসহ টাকার অবমূল্যায়ন, আমদানি বৃদ্ধি ও রফতানি হ্রাসের কারণে বাণিজ্য ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্রমহ্রাস এবং জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের উৎপাদন গত এক যুগে অনেক বেড়েছে, যা আমাদের অর্থনীতিকে বদলাতে অনেক সহায়তা করেছে। তবে বিভিন্ন খাতে আরও উৎপানশীলতা বৃদ্ধির সুযোগ আছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলেন, যদি আগামী কয়েকবছর বহুমুখী খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে শুল্কমুক্ত বা কম শুল্কে বাণিজ্য করলেও বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না, বরং চলমান অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। স্বল্প উন্নত রাষ্ট্র থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কারণে, বাংলাদেশের পরবর্তী অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিষয়ে এই পরামর্শ দেন তাঁরা।
অর্থনৈতিক সুযোগগুলো দেশের সাধারণদের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কথা উল্লেখ করেন তাঁরা বলেন, ‘বাজারভিত্তিক অর্থনীতির দিকে গেলেও, দেশের গরিব মানুষ যাতে বাদ না পড়ে, তারা যাতে পিছিয়ে না যায়– সেজন্য কী করণীয়, সে ব্যাপারেও শেখ হাসিনা সচেষ্ট। তাই আমরা অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বলছি– তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) একটি ব্যালেন্স করার চেষ্টা করছেন। মূলত, বাজার অর্থনীতি খুব শক্তিশালী, উদ্যমী শক্তিকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয় এই অর্থনীতি। সেই সঙ্গে প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষকে দেখে রাখার এবং তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করার যে তাগিদটা আছে– এই দুটোর মধ্যে ব্যালেন্স করা দরকার এবং সেটাই উনি (প্রধানমন্ত্রী) করছেন বলে আমাদের মনে হয়।‘
এ কথা বলা বাহুল্য যে, স্বাধীনতার ৫২ বছরে বাংলাদেশকে অনেক চড়াই–উতরাই পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশকে প্রতিনিয়ত অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির (রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, দুর্নীতি ইত্যাদি) পাশাপাশি বৈশ্বিক নানা ধরনের ঝুঁকি (বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, মহামারি, আন্তর্জাতিক বাজার অস্থিরতা, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি) মোকাবেলা করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ অনেক ঝুঁকির মধ্যে করোনা মহামারি, দুর্নীতি ও পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা থেকে উত্তরণের পথ বের করা যায়নি। গত দুই দশকে বহির্বিশ্ব থেকে প্রথম ধাক্কা আসে যখন মাল্টিফাইবার অ্যাগ্রিমেন্টের আওতায় পোশাক রপ্তানিতে কোটা সুবিধা উঠে যায়। আমরা অনেকে ভেবেছিলাম বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় আর টিকতে পারবে না। কিন্তু সব কিছু ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং ধীরে ধীরে শিল্পটি বড় হয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে এখানে বিদেশি অর্থায়নেও পরিবর্তন আসছে। আগে এক ধরনের দাতা সংস্থা অর্থায়ন করত; এখন অন্য ধরনের বিদেশি প্রতিষ্ঠান আসছে। যেমন বিল গেটস ফাউন্ডেশন এখন স্বাস্থ্যসেবায় এগিয়ে আসছে। আবার ব্র্যাক নিজেই নিজের সামাজিক কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করছে। সার্বিকভাবে এনজিও জগৎ এখন নতুন কর্মসূচি উদ্ভাবনের চ্যালেঞ্জে রয়েছে। নতুন চাহিদাও তৈরি হয়েছে, যেখানে এনজিওগুলোর এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার যথাযথ ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে আগ্রহ লাগবে। যেমন সরকার শিক্ষা খাতে ব্যাপক ব্যয় করছে। তারপরও সেখানে সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষক প্রশিক্ষণের কথা বলা যায়। সরকার চাইলে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্র্যাককে কাজে লাগাতে পারে। নগর স্বাস্থ্য, বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্র্যাকের যে সাংগঠনিক দক্ষতা রয়েছে, সেটি কাজে লাগাতে পারে। আবার বিচার ব্যবস্থায় মামলার যে জট রয়েছে, সেখানে মামলাজট কমাতে এডিআর তথা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে উন্নয়ন সংস্থাগুলোকেও কাজে লাগাতে পারে। উন্নয়ন সংস্থাগুলো এক ধরনের ভূমিকা রাখছে। সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক মানসিকতা না নিয়ে, তাদের ওপর আস্থা রেখে কাজে লাগালে নিঃসন্দেহে আরও ভালো উদাহরণ তৈরি হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের পরিবর্তনে বেসরকারি খাতেরও ব্যাপক অবদান। এখানে অর্থনীতি, সুশাসন, রাজনীতি– সব জায়গায় একটি সংকট যেমন স্পষ্ট, তেমনি এর সঙ্গে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ একত্র হয়ে সমস্যা আরও তীব্রতর হচ্ছে। কিন্তু এসব সমস্যা তো আমাদেরই সমাধান করে এগোতে হবে।