বৈশাখ আসে, বাবা আসে না

শিউলী নাথ | শনিবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

পিক্সেল কোটর্স বলেছেন, ‘একজন বাবা তার ছেলের কাছে প্রথম হিরো ও মেয়ের কাছে প্রথম ভালোবাসা’। ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণেই রয়েছে পরিতৃপ্তি, শ্রান্তি ও নির্ভরতা। সমস্ত বিশ্বাসের বুনিয়াদ যেন বাবা নামক বট বৃক্ষটাকেই আষ্টেপিষ্টে বেঁধে রেখেছে। যদিও ফ্যানি ফার্ণ এর মতে, ‘মেয়েদের কাছে বাবা মানেই ভালোবাসার আরেক নাম’। কিন্তু বাবা তার সন্তানদের সমভাবেই ভালোবাসেন। সে ভালোবাসা কখনোই বাবা প্রকাশ করেন না। এটা মনে হয় বাবাদেরই ধর্ম। আসলে সন্তানদের প্রতি ফোঁটা রক্তে রয়েছে বাবার প্রতি ফোঁটা ঘামের অবদান। অ্যানি গ্যাডেস বলেছেন, ‘যেকোনো পুরুষই বাবা হতে পারে তবে প্রকৃত বাবা হতে কিছুটা বিশেষত্ব দরকার’। একজন বাবা সন্তানকে কতটা ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন, তার মধ্যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন তা তার সন্তানেরাই ভালো বলতে পারে। শৈশবের যতটুকু স্মৃতি মনে পড়ে তা থেকে শুরু করে কৈশোর ও তারুণ্যের উচ্ছল দিনগুলোতে ‘বাবা ও বৈশাখ’ আমার মনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পেশায় চিকিৎসক, নেশায় সংস্কৃতির ধারকএমন একজন বাবার ছায়ায় দিন কাটিয়েছি তা ভাবতেই গর্ববোধ করি।

বৈশাখের প্রথম দিনে গরিব দুস্থদের ফ্রি চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ বিতরণ ছিল বাবার কর্তব্যের অন্যতম। যদিও ওই সেবা ব্যবস্থাটি বাবা নিজের মায়ের নামে উৎসর্গ করতেন। আমাদের সময়ে পহেলা বৈশাখের আগের দিন থেকেই আনন্দ হুল্লোড় চলতো। চৈত্র সংক্রান্তিতে ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো। বাবা বলতেন, সূর্য মামা যেন বিছানায় না দেখে। তাই খুব ভোরে উঠে মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কৃষ্টি পালনে ব্যস্ত হতাম। কাল্পনিক শত্রু নিধন করে পিষে রাখা কাঁচা হলুদ ও নিম পাতা দিয়ে স্নান করতে হতো। স্নান শেষে নিমপাতা মুখে দিতে হতো। বাবার সাথে প্রার্থনায় বসে গীতা পাঠ করতে হতো। বাবা নিজেই আমাদের গীতা পাঠ শিখিয়েছিলেন। সবজি, শাক, লতাপাতা, বিভিন্ন উপকরণে তৈরি পাচন ছিল সেদিনের বাধ্যতামূলক খাবার। যদিও দই, খই, কলা, চিড়া ও মিষ্টির সমন্বয়ে ছিল সুস্বাদু প্রাতঃরাশ। পাচনের গুণাগুণ বিশ্লেষণে বাবা অতুলনীয়। এটি শরীরে হজম শক্তি বাড়ায়। অনেক রোগ ব্যাধি দূর করে। কিন্তু কৈশোরের ওই মনে পাচনের প্রতি অনাগ্রহ থাকলেও প্রকাশের উপায় ছিল না। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রাখতে আমাদেরও প্রাণপণ চেষ্টা চলত। বাবা গর্ব করে বলতেন ‘ছেলেমেয়েরা আজ পাচন খেয়েছে’।

পহেলা বৈশাখের ভোরে স্নান ও প্রার্থনা শেষে বড়দের প্রণাম করা যেন প্রতিযোগিতায় রূপ নিত। বাবাকে আগে কে প্রণাম করবে? কারণ বেশি প্রণামীটা বাবার কাছ থেকেই আসবে। বেশি ভিড় বলে বাবার সাথেই বৈশাখী মেলায় যাওয়া হতো। পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো বিশেষ করে বিকালেই হতো। বাবার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ‘রায়পুর সংগীত বিদ্যালয়’ থেকে উপজেলা প্রাঙ্গণে ঘাসের ওপর বসে কত অনুষ্ঠান করেছি। বট পাতায় ‘নববর্ষের শুভেচ্ছা’ লিখে প্রশাসনের সবাইকে বিতরণ করেছি। একদিকে এসো হে বৈশাখ অন্যদিকে বাবার বেহালার সুর এখনো কানে বাজে। যতদিন বাবা ছিলেন ততদিন পহেলা বৈশাখ জাঁকজমক ভাবেই উদযাপিত হতো। বৈশাখের ঝড়ে সবাই আম কুড়াতো। নায়েবদের বাগানে আম কুড়াতে গিয়ে একবার বাবার হাতে চড় খেয়েছি। খুব মনে পড়ে সেদিনই বাবা রাতে আমাকে আদর করে হারমোনিয়াম বাজাতে বসিয়ে দিলেন। নিজে ভায়োলিন নিলেন। বাবা অমনই ছিলেন। বৈশাখের প্রবল ঘূর্ণিঝড় উপেক্ষা করে ছাদে শিলা কুড়ানোর আনন্দ নিমিষেই শেষ হয়ে যেত বাবার রক্ত চক্ষু দেখে। কারণ বাবা জানতেন ঠাণ্ডায় আমার সমস্যা হয়। পড়ালেখা গান সব লাটে উঠবে, এটাই ছিল বাবার ভয়।

বৈশাখের সকল আনন্দে জীবন যখন উদ্বেল, ঠিক তখনই এমন এক বৈশাখ আমাদের জীবনে নেমে এলো যেখানে চিৎকার করে প্রাণপণে বাবা, বাবাবলে ডাকার পরেও আর ফিরে তাকালো না। হাসপাতালে নিষ্প্রাণ দেহকে ছোটবেলার মতো কতভাবে জড়িয়ে ধরেছি, চুমু খেয়েছি কিন্তু ‘কিরে মা’

এই শব্দটি আর বলল না। জীবনের কঠিন বাস্তবতার কাছে আমরা হার মেনে গেলাম। প্রতি বছর স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে বৈশাখী ঝড়ের অপেক্ষায় থাকি। বৈশাখ আসে প্রবল বেগে ঝড় নিয়ে কিন্তু বাবা আর আসে না! এই ক্ষুদ্র জীবনে অনেকের ভালোবাসা পেয়ে ধন্য হয়েছি। কিন্তু মাইকেল রত্নদ্বীপের বাণীকেই চির সত্য বলে মেনে নিয়েছি

একজন মেয়েকে তার বাবার চেয়ে অন্য কেউ বেশি ভালোবাসতে পারে না’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি আর আমার বার্ধক্য
পরবর্তী নিবন্ধশেয়ারবাজার সর্বত্রই কলুষমুক্ত থাকুক