বৃত্তের বাইরে যাবার জন্য মুখিয়ে ছিল শৈশব হতেই। অনেক প্রশ্ন আর কৌতূহল তার চারপাশের জগত নিয়ে। প্রথম প্রশ্ন মায়ের কাছে– ‘কেন আমাকে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয়? তুমিতো একদিনও যাওনা’। বড়বোন ও ভাইয়েরা যখন মন দিয়ে লেখাপড়া করে, একের পর এক সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গ্রামে বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে, তার তখন লেখাপড়া ছাড়াও অন্যকিছু করার সাধ জাগে। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র তখন। খবরের কাগজে ছাপানো ফুটবল বিশ্বকাপের কুইজের উত্তর লিখে খামে ভরে চাচাতো বোনকে দিয়েছিল পত্রিকা অফিসের ঠিকানা লিখে দিতে। দু’দিন যেতে না যেতেই চিঠি আসে তার নামে। আনন্দে বিহ্বল বালক– এতদিনে মনের আশা পূরণ হল। কিন্তু একী! খাম খুলে চোখ ছানাবড়া। তার হাতে বিশ্বকাপ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর লেখা সেই কাগজের টুকরোটাই ফিরে আসে। কেমন করে এমন হল! দ্রুততম সময়ে তদন্তের ফলাফল পাওয়া যায় সকলের আস্থা, নির্ভরতা ও ভালোবাসার প্রতীক আপাটি ভুলবশত প্রাপকের স্থলে প্রেরকের এবং প্রেরকের স্থলে প্রাপকের ঠিকানা লিখে দিয়েছিল। আপার আর দোষ কি ! তিনিও তখন নিতান্তই কিশোরী। বাড়িতে হাসির রোল ওঠে তাকে নিয়ে। বালকের বুক ভেঙে যায়। তবে দমে যাওয়ার পাত্র সে নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে ফেলে গল্পের পর গল্প। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই একদিন ছাপা হয়ে যায় ‘পাখি’ নামের একটি গল্প। এরপর কখনও গল্প, কখনও কবিতা। কিছু না কিছু লিখছে সে। ততদিনে গ্রামের পাঠ চুকিয়ে মা, বাবা, বোন ও ভাইদের সঙ্গে শহরের এসে থিতু হয় বালক। চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার বৈলছড়ি গ্রামের সেই অদম্য বালকটিই ২০২৩ সালের বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের নিউ কারেন্টস বিভাগে প্রথম বাংলাদেশি সিনেমা হিসেবে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পাওয়া ‘বলী’ (দ্য রেসলার)-এর পরিচালক ইকবাল হোসাইন চৌধুরী।
গেল শতকের নব্বই’র দশকের প্রথমার্ধে বাবার কর্মসূত্রে চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ ব্যাংক কলোনীতে নোঙর ফেলে ইকবালদের পরিবার। বাসায় টেলিভিশন নেই। বন্ধুরা ক্লাসের ফাঁকে বিটিভিতে প্রচারিত সাপ্তাহিক নাটক, ধারাবাহিক নাটক, জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান আর ফুটবল কিংবা ক্রিকেট নিয়ে গল্প করে। সেই জমজমাট আড্ডায় যোগ দিতে না পেরে মনটা খুব ছোট হয়ে থাকে তার। প্রতিবেশীর বাড়িতে রঙিন টিভি আসার পর বাবার কাছে অনেক অনুনয় করেছিল ওদের পুরনো ছোট্ট সাদাকালো টেলিভিশনটা কিনে দেওয়ার জন্য। বাবা সম্মত হননি। বাবার বিশ্বাস এই বাক্সটিই যত নষ্টের গোড়া। টেলিভিশনহীন বাড়িতেই পার করে দেয় একে একে অনেকগুলো বছর। ব্যাংক কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক আর চট্টগ্রাম কলেজ হতে সাফল্যের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের পালা সাঙ্গ করে ঢাকায় যাবার পণ করে পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান ইকবাল।
বড়দের কেউ তখনও চট্টগ্রামের বাইরে পা দেয়নি। গায়ে জ্বর নিয়েই বাড়ি ছাড়ে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে বলে। রোগেশোকে ক্লান্ত বিধ্বস্ত। সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর নিকটাত্মীয়দের সহযোগিতায় অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে ধীরে ধীরে পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পায় ইকবাল। এবার জীবন তরী নোঙর ফেলে রাজধানীর বুকে। এই যে সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়া, তার অর্থ কিন্তু সীমা লঙ্ঘন করা নয় কিংবা নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, পরিবারকে অগ্রাহ্য করে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়াও নয়। ছুটিতে বাড়ি এলে সে আগের মতোই মায়ের আঁচল ধরে ঘুরঘুর করে। গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে আব্বুর পাশে। ভাইদের নিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে। শেকড় তাকে বড় টানে। শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা আজও অটুট, যদিও সে এবার জীবন নৌকা ভিড়িয়েছে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপাড়ে– উত্তর আমেরিকা মহাদেশের টরেন্টো শহরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর বাবা ভাবছিলেন বড় ছেলের পথ ধরে ছোট ছেলেটিও হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। আর আল্লাহ চান তো যদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়ে যায়, তবেতো ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে আসবে। হায়রে পিতার অবুঝ মন! তাঁর এ–ছেলেটি যে ঘরে ফেরার নয়, বাবা তা মেনে নিতে পারেননা। তাই বলে পুত্রকে নিয়ে গর্বেও কমতি নেই পিতার। প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর সহ–সম্পাদক হিসেবে নাম কুড়োতে শুরু করেছিল ইকবাল ছাত্রাবস্থাতেই। ছাপার অক্ষরে ছেলের নাম দেখে পরিতৃপ্তি অনুভব করেন বাবা। শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’ অনেক যত্ন করে সংরক্ষণ করেন। তবে বৃহস্পতিবারের ‘আনন্দ’ পাতাটি বাড়ির কেউ দেখার আগেই অদৃশ্য করে দেন। বিনোদনে তাঁর মন ঠিক সায় দেয়না। হয়তো লেখা–পড়া, ধর্ম–কর্ম হতে মন উঠে যাওয়ার আশংকায়। বিনোদন নিয়েও যে লেখাপড়া হয়, উচ্চশিক্ষা হয়, গবেষণা হয়, সর্বোপরি দেশের জন্য কাজ করা যায়, দেশকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করা যায় বাবার ভাবনায় এতোসব নেই।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস ছেড়ে দুই কামরার ঘর ভাড়া করে ইকবাল। সঙ্গী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ হতে স্নাতকোত্তর শেষ করে ঢাকায় থিতু হওয়া মেজভাই। ঢাকার শ্যামলীতে দুই ভাইয়ের সেই নতুন আস্তানায় তখনও হাঁড়িকুঁড়ির ঠিকঠিকানা নেই, খাট পালঙ্ক নাই, কিন্তু বড় একটা রঙিন টেলিভিশন ঠিকই কেনা হয়ে যায়। কয়েক বছরের মাথায় ইকবাল উড়াল দেয় ফ্রান্সে, গন্তব্য কান চলচ্চিত্র উৎসব। তবে ইতোপূর্বে কাজ নিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ভারত আর সিঙ্গাপুর ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করেছিল। দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদকর্মী হিসেবে ফ্রান্সের সমুদ্র শহর কান থেকে উৎসবের খবর, তারকাদের সাক্ষাৎকার ও ছবি নিয়ে প্রতিদিন প্রতিবেদন প্রেরণ করে। চোখের সামনে নিকোল কিডম্যানকে দেখে চমকে ওঠে তরুণ। অস্কারজয়ী রূপালি পর্দার তারকারা মর্ত্যলোকে হেঁটে বেড়ায়। লাল গালিচায়, সমুদ্র সৈকতে, পান্থনিবাসের আশেপাশে রক্ত মাংসের মানুষদের মতোই চলতে ফিরতে দেখা যায় তাদের! কানের নিয়মিত যাত্রী হিসেবে টানা কয়েক বছরে হলিউডের নামজাদা প্রায় সকল তারকাকেই কাছ থেকে দেখা হয়ে যায়।
একদিন এ–কাজেও একঘেঁয়েমি চলে আসে। আর ভালো লাগেনা ক্যামেরা নিয়ে তারকাদের পেছনে ছুটে বেড়াতে (‘টায়ার্ড অব চেসিং সেলিব্রেটিজ’)। ঢেউ ওঠে মনের ভেতর, এই কি তার করার কথা? না কি অন্যকিছু? কিছুদিন মন ঢেলে দেয় টেলিভিশনের জন্য নাটক নির্মাণে। বইও লিখে ফেলে গোটাকয়। কক্সবাজার থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি ট্যাবলয়েড কাগজের সম্পাদনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সুবাদে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের কোল ঘেঁষে বসবাস করে কয়েকটি মাস। সৃজনশীলতার সকল শাখায় কমবেশী বিচরণ করে। তবে স্বস্তি মেলেনা। কি এক স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায়, হাতছানি দিয়ে ডেকে যায় কোন এক অজানা বন্দরে!
আবারও বৃত্ত ভাঙার পণ করেন ইকবাল। চলচ্চিত্র নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে উড়ে যান দক্ষিণ গোলার্ধে; অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে। দেশে ফিরে এসে বছর না ঘুরতেই পাড়ি দেন বিলেতে। সড়ক পথে চষে ফেলেন ইউরোপের নানা জনপদ। দেশে দেশে অনেক ঘোরাঘুরির পর মন আরও চঞ্চল হয়। নানান রঙের, নানান জাতের, নানান ভাষার মানুষদের দেখে দেখে আরও দেখার সাধ জাগে, জানার সাধ জাগে, পড়ার নেশা জাগে। অল্পকাল পরে অভিবাসীর টিকেট নিয়ে পাড়ি জমান কানাডায়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে ‘বলী’ র গল্প মাথায় নিয়েই পাকাপাকিভাবে দেশ ছাড়েন তিনি। আগে পরে স্বল্প দৈর্ঘ্যেও কিছু চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম এন্ড মিডিয়া বিভাগে নাম লিখিয়ে নতুন করে ছাত্রজীবন ফিরে পাওয়ার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। অচিরেই ছায়াছবি নির্মাণের কলাকৌশল ও দর্শন নিয়ে জ্ঞানলাভ হয়, যা তাঁকে গল্প নিয়ে, চরিত্র নিয়ে, দৃশ্য নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের শক্তি যোগায়। ফলাফল ‘বলী’র চিত্রনাট্যের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান লাভ। ২০২২– এর বসন্তে দৃশ্য ধারণের জন্য ইকবাল ফিরে আসেন মাটির কাছে, সমুদ্রের কাছে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বলীখেলা আর সেই সঙ্গে সাগর পাড়ের এক খ্যাপাটে জেলের গল্প– এ ছায়াছবির মূল উপজীব্য। বুসানে বিচারকমণ্ডলী অবশ্য ‘বলী’ কে একটি ‘আকর্ষণীয় সিঙ্গেল রাউন্ড ম্যাচে’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যাতে দুর্দান্ত এক গল্প বলা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে বিলুপ্তপ্রায় চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা ‘বলী’ ছায়াছবির প্রাণ।
নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ‘বলী’ চলচ্চিত্রের কলাকুশলীরা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে বাঁশখালীর সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রামে অবস্থান করেন দিনের পর দিন। সাগর পাড়ে মাটির মানুষদের সঙ্গে অনেকগুলো দিনরাত্রি কাটিয়ে ধারণ করা টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো নিয়ে পরিচালক ইকবাল ফিরে যান নিজ ডেরায়, টরেন্টো শহরে। দৃশ্য, সংলাপ জোড়া দেন অনেক যত্ন করে। প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় ‘বলী’র। এবার তাকে অবমুক্ত করার পালা। প্রদর্শনীর ভাল কিছু সুযোগ এসেও হাতছাড়া হয়ে যায়। মন ভাঙে, আবার বাঁধে। আগল খুলে দেন ছেলে মায়ের কাছে। অবাক শোনালেও মা– কে তিনি ‘মাদার’ বলে সম্বোধন করেন ছেলেবেলা হতে। ‘মায়ের দোয়া’র কাঙাল ছেলে। রাত ফুরিয়ে যায়, মাতা পুত্রের কথা শেষ হয়না। বলাবাহুল্য ছোট ছেলের মাঝে সৃজনশীলতার বীজটি সঞ্চারিত হয়েছিল তাঁর ‘মাদার’ এর কাছ থেকেই। সংসারের হাঁড়ি ঠেলে, আর খুন্তি–কড়াই, তেল– নুনের হিসেব মেলাতে গিয়ে খাতা কলম নিয়ে বসার সুযোগ খুব একটা মেলেনি মায়ের। তবে অর্ধশতবর্ষের আলমারিটি খুলে দেখলে শাড়ির ভাঁজে দুএকটি লেখার খাতা আজও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।
১৩ অক্টোবর, ২০২৩, শুক্রবার সকাল– ‘বলী’র বিজয়ের খবর আসে দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান হতে। কয়েক ঘণ্টা পর পর্দা উঠে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চের। প্রথাগত বক্তৃতায় অনভ্যস্ত ইকবাল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পুরস্কারটি উৎসর্গ করেন বলী’র ছোট্ট একটি চরিত্রে রূপদানকারী একজন সদ্য প্রয়াত শিল্পীকে, আর তাঁর মরহুম বাবাকে, যিনি বিশ্বাস করতেন সিনেমা দেখা পাপ। বাবার বাধাই তাঁকে চলচ্চিত্র নির্মাণে আরও বেশী আগ্রহী করে তোলে। কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় জীবন যাপন করা বাবাটির চলচ্চিত্র উপভোগের সময়, সুযোগ, ইচ্ছে কোনটাই ছিলনা। সম্ভবত গতানুগতিক চলচ্চিত্রে অশোভন নাচ গান আর অশ্লীলতার জোয়ার বয়ে যায় বলে শুনেছিলেন কোনো বন্ধু কিংবা সহকর্মীর কাছ থেকে। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই– সন্তানদের সৎ ও সহজ পথে পরিচালিত করা। তারা যেন কোনভাবেই পা পিছলে না যায়, তা নিশ্চিত করতে গিয়ে তাঁর প্রজন্মের আরও অনেক বাবার মতোই কঠোর অনুশাসন বলবৎ রেখেছিলেন পারিবারিক পরিমণ্ডলে। তিনি হেরে যাননি। বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপনী উৎসবের মঞ্চে পাওয়া পদকটি উর্ধ্বে তুলে ধরে তাঁর সেই ছোট্ট ছেলেটি যখন ‘আব্বু দিস ইজ ফর ইউ’ বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে, মিলনায়তনের ছয় হাজার দর্শককে ছুঁয়ে যায় অভাবনীয় সেই দৃশ্য। ঠিক যেমন ‘আমি জিতলে জিতে যায় বাবা’।