বৈধ অস্ত্রের অনৈতিক ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈধ অস্ত্র মালিকরা শর্ত মানছেন না। তাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করে জনমনে ভীতি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠছে বেশি। ৫ হাজার অস্ত্র ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
এ অবস্থায় আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৈধ লাইসেন্সধারীদের অস্ত্রের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। ইতোমধ্যে বিভাগীয় কমিশনারদের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় নতুন করে বৈধ লাইসেন্সধারী অস্ত্র ব্যবহারকারীদের হালনাগাদ তথ্য চাওয়া হয়েছে। ডিজিটাল আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (ডিএএমএস) ডাটা এন্ট্রির জন্য বেশ কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কারো বিরুদ্ধে বৈধ অস্ত্রের অপব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সূত্র মতে গত ছয় বছরে অন্তত পাঁচ হাজার লাইসেন্সধারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে ৫ হাজার অস্ত্র ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। অস্ত্রগুলোর বিষয়ে তদন্ত করতে সমপ্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে রেঞ্জের উপ–মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), জেলার পুলিশ সুপার ও ইউনিট প্রধানদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। বেশিরভাগ অভিযোগেরই সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ইতিমধ্যে সেই প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সব লাইসেন্সধারীর অস্ত্রগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে তাও তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে। অনেকের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও নবায়ন করছেন না।
‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা ২০১৬’ আইনে কেবল আত্মরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তা ছাড়া, এই অস্ত্র অন্য কোনো প্রয়োজনে ব্যবহারের বিধিনিষেধ আছে। এমনকি কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ‘টেস্ট ফায়ার’ও করা যাবে না। ব্যক্তিগত অস্ত্র লাইসেন্সধারী ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও ব্যবহারের অনুমতি নেই। এমনকি কোনো ব্যক্তি দেহরক্ষীকে ব্যবহারের জন্যও দিতে পারবেন না, বিশেষ কোনো প্রয়োজনে দেহরক্ষীকে ব্যবহার করতে হলে তার নামে লাইসেন্স থাকতে হবে।
এই পর্যন্ত সারা দেশে ৪৫ হাজার ২০৮টি অস্ত্রের লাইসেন্সের তথ্য সংরক্ষণ করেছে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট। তার মধ্যে ৪১ হাজার ৫১২টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে ব্যক্তির নামে। বাকি ৩ হাজার ৬৯৬টি অস্ত্র রয়েছে আর্থিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। যেসব অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে সেগুলো হচ্ছে একনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, উজিগান, রিভলবার ও রাইফেল। এসব অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার তালিকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর নামও রয়েছে। এমনকি একজনের নামে একাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তা বলেন, নানা কারণে অন্তত পাঁচ হাজার লাইসেন্সধারীর তদন্ত শেষের দিকে। প্রতিবেদন হাতে এলে সেগুলোর লাইসেন্স বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু হবে। তা ছাড়া অস্ত্রের ডেটা তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। কেউ অস্ত্র কিনলে সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রের কোডসহ থানা পুলিশকে জানাতে অস্ত্রের দোকানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা আরও বলেন, রাজনৈতিক ক্যাডার ও অপরাধীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ছোট অস্ত্র। তাদের আগের তালিকায় রয়েছে উগনি কোম্পানির পিস্তল, মাউজার পিস্তল, ইতালির পেট্রো বেরোটা পিস্তল, জার্মানির রুবি পিস্তল। তারা বলেন, আমরা প্রায়ই তথ্য পাচ্ছি কেউ কেউ বৈধ অস্ত্র ভাড়া পর্যন্ত দিচ্ছেন। তাদের তালিকাও আমরা করছি। যারা বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র দিয়ে অপকর্ম করছে তাদের ধরতে শিগগির বড় ধরনের অভিযান চালানো হবে। মন্ত্রণালয় সেই বিষয়ে আমাদের বেশকিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৈধ অস্ত্রধারীদের তথ্য সংগ্রহের কাজে অবগত থাকার জন্য বিভাগীয় কমিশনার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা তথ্য কর্মকর্তা, আইসিসি অধিদফতরের জেলা কার্যালয়ের প্রোগ্রামার, সংশ্লিষ্ট এলাকার থানাগুলোর বিভাগীয় ইনচার্জ এবং লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে ডাটা এন্ট্রির জন্য লাইসেন্সধারী ব্যক্তির লাইসেন্স নম্বর, এনআইডি নম্বর, জন্মনিবন্ধন যদি থাকে, আয়কর সনদ, মোবাইল নম্বর, ইমেইল, রক্তের গ্রুপ, স্বাক্ষর ও পাসপোর্ট সাইজের দুই কপি ছবি জমা দেওয়ার জন্য চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট জেলার জুডিসিয়াল মুন্সিখানা শাখায় এসব কাগজপত্র জমা দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্রের দাবি, নির্বাচনকে সামনে রেখে বৈধ অস্ত্রের ব্যবহারকারীরা কেউ যাতে কোনও ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড করতে না পারে, বা কেউ কোনও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটালে তাকে যেন শনাক্ত করা যায়, সে কারণেই তথ্যগুলো চাওয়া হয়েছে। চিঠিতে আরও বলা হয়, লাইসেন্স করা অস্ত্র থাকার পরও যদি কেউ নতুন করে তথ্য না দেয় এবং ডাটা সিস্টেমে লিপিবদ্ধ না করে, তাহলে পরবর্তী সময়ে নির্দেশনা অনুযায়ী এ বিষয়ে কাজ করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।