চট্টগ্রামকে বলা হয় বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের মহানগরের মধ্যে আকারের দিক দিয়ে ঢাকার পরই চট্টগ্রাম। কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাশে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরের একদিকে পাহাড় ও অন্যদিকে সমুদ্র। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরটি চট্টগ্রাম শহরেই। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে গ্রেকো রোমান ভূগোলবিদ ক্লডিয়াস টলেমি তার বিশ্ব মানচিত্রে চট্টগ্রামের অবস্থান তুলে ধরেছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরকে পূর্ব গোলার্ধের অন্যতম সেরা বন্দর হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা এসেছিলেন চট্টগ্রামে। তিনি এ শহরের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। চতুর্দশ শতকে বাংলার সুলতানরা এ চট্টগ্রামে একটি টাকশাল স্থাপন করেছিলেন।
চট্টগ্রামের রাজনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। তা শুধু এ কালে নয়, ১৯১৫ সালেই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেছিলেন, ‘শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য–মহিমায় মহিমান্বিত বলিয়া নহে, অতি প্রাচীনকাল হইতে রাজনীতির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত থাকায়, চট্টগ্রাম রাজনৈতিক লীলাক্ষেত্র এবং ঐতিহাসিকের গবেষণার প্রকৃষ্ট স্থানও বটে।’
দেড়শ বছর আগে ব্রিটেনের নাগরিক আর্থার লয়েড তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ লিভস ফ্রম আ ডায়েরি ইন লোয়ার বেঙ্গল–এ চট্টগ্রাম শহরের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন ঠিক এইভাবে, ‘ভাটিবাংলার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা চাটগাঁ। নিচু টিলা, তার চূড়ায় বাড়ি, ঘুরে ঘুরে হেঁটে উঠতে হয়। কোনো কোনো পাহাড়ে বা টিলায় উঠলে চমৎকার সব দৃশ্য চোখে পড়ে। দূরে দিগন্তে কর্ণফুলী গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে, চারপাশে ছড়ানো–ছিটানো পাহাড়ের চূড়ায় বিন্দুর মতো সাদা বাংলো।’ তিনি ১৮৭১ থেকে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত দুই দফায় চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন।
একসময় চট্টগ্রামে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছিল। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে ছিল চট্টগ্রামে একটি বড় বসতি যা মগ দস্যুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। এ জেলায় ছিল আরব আর বর্মিদের, আর ছিল পর্তুগিজ আর ইংরেজদের ব্যবসা–বাণিজ্য। ঐতিহাসিকভাবে চট্টগ্রামকে বলা হয় প্রাচ্যের রানি। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোতধারাকে সাক্ষী রেখে গড়ে ওঠা হাজার বছরের জনপদ। তবে শহরের মর্যাদা মিলেছে ১৮৬৩ সালে। মিউনিসিপ্যালিটি হলেই কি আর রাতারাতি নগরসভ্যতা দাঁড়ায়! শহরের বাড়বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিদ্যাপীঠ, চিকিৎসাকেন্দ্র, সড়ক, যানবাহন, বাজারসদাইয়ের বিপণিকেন্দ্র কতো কিছুই যে দরকার হয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরলয়ে শহরের যাবতীয় অনুষঙ্গ গড়ে ওঠে। এই যেমন মর্যাদাপ্রাপ্তির শত বছর পর চট্টগ্রামে প্রথম বহুতল আধুনিক বিপণিকেন্দ্র গড়ে ওঠে। নাম ‘বিপণী বিতান’। ডাকনাম নিউমার্কেট। এ শহরের প্রথম আইকনিক স্থাপনা। চলন্ত সিঁড়িসহ চারতলা ভবনটি চট্টগ্রামের প্রথম আধুনিক বাণিজ্যালয়। নতুন মার্কেট থেকে ‘নিউমার্কেট’ নামের উৎপত্তি। সে কারণে আসল নাম ঢাকা পড়েছে নিউমার্কেটের ভেতর।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর চট্টগ্রামের মনিহারি, বস্ত্রসহ নানা পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল কয়েকটি বড় দোকান। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ওয়াদুদ মালাবার স্টোরস, লাকি স্টোরস, সিটি স্টোরস, মজুমদার ব্রাদার্স, চন্দ স্টোরস ইত্যাদি। এ ছাড়া টেরিবাজার ও রেয়াজুদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক কিছু দোকান ছিল। এক ছাতার নিচে রকমারি পণ্যের কেনাকাটার সুবিধা নিয়ে ১৯৬৪ সালে গড়ে তোলা হয় ‘বিপণী বিতান’। ৪৮০টি দোকান নিয়ে এ মার্কেটের যাত্রা।
আমান উল্লাহ চৌধুরীর ‘আধুনিক চট্টগ্রাম ও সিডিএ’ বইয়ে বিপণী বিতান নির্মাণের আদ্যোপান্ত উল্লেখ রয়েছে। এ মার্কেটের নামকরণ করেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তখনকার জনসংযোগ কর্মকর্তা এ বি চৌধুরী। ১৯৬১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খান। খ্যাতিমান স্থপতি ফিদা হোসেন ওরফে জি ইব্রাহিম ২ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট আয়তনের এই বিপণিকেন্দ্রের নকশা করেন। নির্মাতা ছিল এম এ কাশেম ও সিরাজুল হক অ্যান্ড ব্রাদার্স।
শুরু থেকেই জমজমাট ছিল আধুনিক এই বিপণি বিতান। এক ছাদের নিচে পোশাক, রূপলাবণ্যচর্চার উপকরণ, রান্নাঘরের সামগ্রী, গৃহসজ্জা, ইলেকট্রনিক পণ্য, মনিহারি, কার্ড, খাবার, বিনোদনের সামগ্রী সবই যে মেলে এখানে। চট্টগ্রামের তখনকার জনপ্রিয় ও আদি যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব কটিই তখন নিউমার্কেটে দোকান কেনে।
নিউমার্কেটের একতলায় উজালা ও নিউজফ্রন্ট, দোতলায় বইঘর আর চারতলায় মনীষায় পাঠকদের ভিড় লেগে থাকত সব সময়। সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকে এই বইয়ের দোকানগুলোয় জমজমাট বেচাকেনা হতো। সৈয়দ মোহাম্মদ শফি ১৯৬০ সালে ‘বইঘর‘ প্রতিষ্ঠা করেন। দুই বাংলার অন্যতম সেরা প্রকাশনা সংস্থা ছিল ‘বইঘর’। ‘বইঘর‘ থেকে বঙ্কিম রচনাবলী, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, শহীদ কাদরী, এখলাস উদ্দিন, পুর্ণেন্দু পত্রী, লীলা মজুমদারের বই প্রকাশিত হয়েছে। বইগুলোর প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছিল খালেদ চৌধুরী, পুর্ণেন্দু পত্রী, কাইয়ূম চৌধুরীর মতো নন্দিত শিল্পীরা।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী রিয়াজুদ্দিন বাজার। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে প্রথম চট্টগ্রামে এসেছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের নেতা কবির বন্ধু হাবিবুল্লাহর বাহারের দাওয়াত এবং কলেজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। হাবিবুল্লাহ বাহার ও তাঁর বোন শামসুন নাহার মাহামুদ পরে কবিকে নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের তামাকুমুন্ডিস্থ তাঁদের বাসায় নিয়ে যান। প্রথমবার চট্টগ্রাম এসে খুব খুশি হয়েছিলেন কবি নজরুল। বেগম শামসুননাহারের কাছে তিনি চিঠি লিখেছিলেন– ‘ফুল যদি কোথাও ফুটে, আলো যদি কোথাও হাসে, সেখানে আমার গান গাওয়ার শোভা পায়, গান গাই। সেই আলো, সেই ফুল পেয়েছিলাম এবার চট্টলায়, তাই গেয়েছি গান। কবিকে খুশী করতে হলে দিতে হয় অমূল্য ফুলের সওগাত‘।
ঐতিহাসিকর মতে, চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের (বটতলি স্টেশনের) উত্তর পাশে নগরের বাইশ মহল্লার কবরস্থানের পাহাড়টির নাম কুমদান পাহাড়। এই পাহাড়ের পূর্ব দিক ও স্টেশন রোডের উত্তর দিকের সম্পূর্ণ এলাকাটি ছিল জমিদার দেওয়ান বৈদ্যনাথের জমিদারির অন্তর্গত। সেখানে তাঁর বাগানবাড়ি ও সেগুনবাগিচা ছিল। এই এলাকাই বর্তমানে রিয়াজউদ্দিন বাজার।
আবদুল হক চৌধুরীর বন্দর শহর চট্টগ্রাম বই থেকে জানা যায়, দেওয়ান বৈদ্যনাথের উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে এলাকাটি চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান বিএবিএল (আইন স্নাতক) শেখ রেয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির বাবা শেখ মোহাম্মদ ওয়াশীল সিদ্দিকি কিনে নেন। রেয়াজুদ্দিনের সময়ে এর প্রথম উন্নয়ন হয়েছিল। তাই এলাকাটির নামকরণ হয়েছে ‘রেয়াজুদ্দিন বাজার’।
বর্তমানে দেওয়ান বৈদ্যনাথের বাড়ির অস্তিত্ব নেই। সময়ের পরিক্রমায় রেয়াজুদ্দিন বাজারও পরিচিতি পায় রিয়াজউদ্দিন বাজার নামে। এখন বিশাল এলাকাজুড়ে এই বাজার অবস্থিত। বাজারে প্রবেশের অন্তত ১৫টি পথ রয়েছে। উত্তরে এনায়েতবাজার, দক্ষিণে স্টেশন রোড, পূর্বে জুবলি রোড এবং পশ্চিমে বিআরটিসির বাসস্ট্যান্ডএ বিশাল এলাকা নিয়েই বর্তমান রিয়াজউদ্দিন বাজার। নগরের স্টেশন রোড এলাকা থেকে বাজারে অন্তত ছয়টি সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে চৈতন্যগলি ধরে এগিয়ে গেলে সব সবজির আড়তের দেখা মেলে। এর পাশে আজাদ হোটেলের পাশের দুটি পথ ধরে ঢুকলে ইলেকট্রনিক ও অন্যান্য পণ্যের বাজার। নূপুর মার্কেটের পাশ দিয়ে কাপড়ের দোকানগুলো। জুবলি রোডের পাশ দিয়ে সবজি ও মুরগি বাজার। এই পথ আরও কয়েকটি গলি হয়ে আবার স্টেশন রোডে সংযুক্ত।
১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাশে পরীর পাহাড়ের পাদদেশে ঐতিহ্যবাহী জহুর হকার্স মার্কেটটির গোড়া পত্তন করা হয়। শুরুতে মাত্র ৮টি দোকান নিয়ে এই মার্কেটের যাত্রা শুরু হয়।
এক সময় এ মার্কেট ‘গরিবের মার্কেট’ এবং ‘টাল কোম্পানি’র মার্কেট হিসেবে পরিচিতি ছিল। কারণ এ মার্কেটে শুধু বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পুরাতন কাপড় বিক্রি হতো।
আর এসব কাপড়ের ক্রেতারা ছিল বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকজন। তাই অনেকে বলতো গরিবের মার্কেট। আর কাপড়গুলো মাটিতে বড় বড় স্তূপ করে বিক্রি করা হতো বলে এটাকে টাল কোম্পানির মার্কেট নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু এখন আর আগের মতো পুরাতন কাপড়ও বিক্রি হয় না, মাটিতে স্তূপ করে কাপড়ও রাখা হয় না। প্রতিটি দোকানে থরে থরে ঝুলছে হাল ফ্যাশনের দেশি–বিদেশি পোশাক। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মিলছে পরিবারের সবার পোশাক।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কাপড়ের ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যকেন্দ্র টেরিবাজার। এটি আন্দরকিল্লা থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে বন্দরনগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। ঢাকার ইসলামপুরের পরে এটিই দেশের পাইকারি কাপড়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্র।
চট্টগ্রামে থান কাপড়ের জন্য বিখ্যাত শত বছরের পুরনো মার্কেট টেরিবাজার। তবে এখন শুধু থান কাপড় নয়; মিলছে সব ধরনের প্রয়োজনীয় কাপড়। গত এক দশকে টেরিবাজারে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ওয়ানস্টপ শপিংমল। যেখানে মিলছে নারী–পুরুষ ও শিশুদের যাবতীয় পোশাক। শুধু খুচরা গ্রাহকই নয়, জেলার বিভিন্ন উপজেলার ব্যবসায়ীরাও এখান থেকে পাইকারি কাপড় কেনাকাটা করেন।
এছাড়া সানম্যার ওশান সিটি, বালি আর্কেড, কেয়ারি ইলিশিয়াম, সেন্ট্রাল প্লাজা, মিমি সুপার মার্কেট, আফমি প্লাজা, ফিনলে স্কয়ার, শপিং কমপ্লেক্স, ইউনেস্কো সিটি সেন্টার, আমিন সেন্টার, ভিআইপি টাওয়ার, আখতারুজ্জামান সেন্টার– এসব শপিংমল–মার্কেটগুলোতে অপেক্ষাকৃত বিত্তবানেরা ভিড় করেন। পাশাপাশি নগরীর জিইসি মোড়, দুই নম্বর গেট, চকবাজার, আগ্রাবাদসহ বিভিন্ন এলাকায় পোশাকের ব্র্যান্ডের শো–রুমগুলোতেও বিত্তবানদের পদচারণায় মুখর থাকে সারাবছর। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের শেষ আশ্রয়স্থল হলো নূপুর মার্কেট, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, মহাজন টাওয়ার, চকভিউ সুপারমার্কেট, কেয়ারি শপিংমল, গুলজার টাওয়ার, আলী মার্কেট, মতি টাওয়ার ও স্বজন সুপার মার্কেট। বছরজুড়ে নগরীর ফুটপাতে সড়কের একপাশে চৌকি বসিয়ে, ভ্যানগাড়িতে ভ্রাম্যমাণ দোকানে জিনসের প্যান্ট, টি–শার্ট, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, শিশুবয়সীদের পোশাক, বেল্ট, নারী–পুরুষ উভয়ের জুতার বিকিকিনি চলে দেদারসে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।