চট্টগ্রামে দিন দিন করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। আগে মহানগর এলাকায় সংক্রমণ বেশি দেখা গেলেও এখন গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। পাল্লা দিয়ে রোগীর চাপও বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। বিশেষ করে গত বেশ কিছু দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এর মাঝে মহানগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। এতে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে হাসপাতালগুলোকে। তবে শয্যা বাড়িয়েও রোগী সামালে হিমশিম অবস্থায় বেসরকারি এসব হাসপাতাল। নগরীর বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রতিদিন করোনায় শনাক্ত ও হাসপাতালে (নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যক) ভর্তিকৃত রোগীর তথ্য সংক্রান্ত আপডেট দেওয়া হয়। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৪ মে চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩৫৯ জন করোনা রোগী ভর্তি ছিল। ১০ জুন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ৪১৪ জন। ২৩ জুন এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯৮ জনে। সর্বশেষ গতকাল ৪ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৬৬ জনে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৫ দিনের ব্যবধানে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৬৫০ শয্যার বিপরীতে গত ১০ জুন ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা দেখানো হয় ২২৮ জন। ২০ জুন এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৯ জনে। সর্বশেষ গতকালের হিসাব অনুযায়ী, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছে ৪২৪ জন। বেসরকারি হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক সপ্তাহ আগেও করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন/শয্যা বেশিরভাগ খালি ছিল। কিন্তু গত কিছু দিনে এ চিত্র পাল্টে গেছে। কিছুদিন ধরে আইসিইউতে চাপ থাকলেও আইসোলেশন কেবিন বা শয্যায় ততটা চাপ ছিল না। অনেক কেবিন/শয্যা খালি ছিল। কিন্তু গত ৮/১০ দিনে রোগীর চাপ এতটাই বেড়েছে যে, বাধ্য হয়ে করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত কেবিন/শয্যা বাড়াতে হয়েছে। তবে এখন গ্রামাঞ্চল থেকে রোগী বেশি আসছেন বলে জানান হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।
হাসপাতালভিত্তিক তথ্য : জানা গেছে, আগ্রাবাদের বেসরকারি মা ও শিশু হাসপাতালে এতদিন ১০৯ শয্যার আইসোলেশনে রোগী ভর্তি করা হতো। তবে রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় সপ্তাহখানেক আগে শয্যা বাড়িয়ে ১৪০ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন মা ও শিশু হাসপাতালের ট্রেজারার রেজাউল করিম আজাদ। এর মাঝে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১২০ শয্যায় রোগী ভর্তি থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, আইসোলেশন ছাড়াও করোনা রোগীদের জন্য আমাদের ১৯টি আইসিইউ এবং ১০টি এইচডিও রয়েছে। সবক’টিতে রোগী ভর্তি। বেশ কিছুদিন ধরে আইসিইউ-এইচডিওর একটি শয্যাও খালি থাকছে না।
করোনা রোগীদের চিকিৎসায় এতদিন ২০টি কেবিন বরাদ্দ ছিল বেসরকারি ন্যাশনাল হাসপাতালে। কিন্তু চাপ বেড়ে যাওয়ায় ৪/৫ দিন আগে আরো ১৬টি কেবিন বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. মো. আমজাদ হোসেন। এখন ৩৬টি কেবিনে ৩৬ জন রোগী ভর্তি জানিয়ে তিনি বলেন, বাড়ানোর পরও শয্যা খালি থাকছে না। নির্ধারিত কেবিনের বাইরেও আরো কয়েকজন রোগী ভর্তি রাখতে হয়েছে। এছাড়া নির্ধারিত ৮টি আইসিইউর ৭টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে। আগে শহরের রোগী বেশি ভর্তি হলেও এখন গ্রামাঞ্চলের রোগী বেশি আসছে। এ রকম পরিস্থিতি হলে কেবিন আরো বাড়াতে হতে পারে।
এতদিন ধরে ৩০টি কেবিনে করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে। কিন্তু রোগীর চাপ সামাল দিতে ৪/৫ দিন আগে কেবিন সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০টি করা হয়েছে। ৬০টি কেবিনে বর্তমানে ৫৮ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন পার্কভিউ হাসপাতালের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ডা. এটিএম রেজাউল করিম। এছাড়া নির্ধারিত দশটি আইসিইউর সবক’টিতে রোগী ভর্তি। অতিরিক্ত দুটি বেড বসিয়ে আরো দুজন রোগীকে আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে আইসিইউর একটি শয্যাও খালি থাকছে না বলে জানান তিনি। এভাবে রোগীর চাপ বাড়তে থাকলে কেবিন সংখ্যা আরো বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে বলে জানান হাসপাতালের জিএম মো. জিয়াউর রহমান।
মেট্রোপলিটন হাসপাতালে এতদিন ১৮টি কেবিনে করোনা রোগী ভর্তি করা হতো। কয়েক দিন আগে কেবিন বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়েছে। ৩৫টি কেবিনে বর্তমানে ৩২ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন বলে জানান হাসপাতালের জিএম মোহাম্মদ সেলিম। এছাড়া আইসিইউ ও এইচডিওতে আরো ৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানান তিনি।
বেসরকারি ম্যাঙ হাসপাতালে প্রথম দিকে ২৮টি কেবিনে করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হতো। কেবিন সংখ্যা বাড়িয়ে এখন ৩৯টি করা হয়েছে। ৩৯ কেবিনের সবকয়টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানান হাসপাতালটির জিএম রঞ্জন প্রসাদ দাশ। এছাড়া নির্ধারিত দশটি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই বলে জানান তিনি।
সিএসসিআর হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য এতদিন ১৩টি কেবিন নির্ধারিত ছিল। তবে রোগীর চাপে কেবিন বাড়িয়ে ২৪টি করা হয়েছে। এর মাঝে ১৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানান হাসপাতালটির আরএমও ডা. এমজাদ হোসেন। এর বাইরে চারটি আইসিইউর ২টিতে রোগী রয়েছে।
সমপ্রতি সেবা চালু করা অনন্যা আবাসিক এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালেও চলছে করোনা রোগীদের চিকিৎসা। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫টি আইসিইউ ও ৫টি এইচডিওর সবকয়টিতে রোগী ভর্তি রয়েছে বলে জানিয়েছেন এভারকেয়ার হাসপাতালের জিএম ফজলে-ই আকবর চৌধুরী।
করোনার ভারতীয় ধরনের (ভ্যারিয়েন্ট) বিস্তার ঘটায় সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ডা. সুশান্ত বড়ুয়া। তিনি বলেন, ভাইরাসের ভারতীয় এ ধরন অন্যান্য ধরনের তুলনায় তিন গুণ বেশি সংক্রামক ও ভয়ানক বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ ধরন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মূলত ভারতীয় এ ধরনের সামাজিক সংক্রমণের কারণেই করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। তবে শঙ্কার বিষয়, এবার গ্রামাঞ্চলেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা সুবিধা বলতে তেমন কিছু নেই। যার কারণে গ্রাম থেকে এসব রোগীকে শহরের হাসপাতালে আসতে হচ্ছে। সংক্রমণ থামানো না গেলে প্রথম ঢেউয়ের মতো কিংবা এর চেয়েও বেশি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি নেমে আসতে পারে।
সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় রোগীর চাপ বাড়ছে বলে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলছেন, সংক্রমণের হার আবারো আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তবে এবার গ্রামাঞ্চলে আক্রান্তের হার তুলনামূলক বেশি দেখা যাচ্ছে। সংক্রমণ ঠেকাতে দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। মানুষ যদি ঘরে থাকে, বিধিনিষেধ মেনে চলে, তবে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। না হয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।