বেসরকারি ল্যাবের টেস্ট বাণিজ্য

রোগী ভাগিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমতো ফি আদায় চমেক হাসপাতাল থেকে দুজন গ্রেপ্তার

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ঘিরে দালালের উৎপাত যেন কমছেইনা। টেস্ট বাণিজ্যের সুবিধার্থে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও আউটডোরে এসব দালাল নিয়োজিত করে রাখে বেসরকারি ল্যাবগুলো। যদিও এসব দালালকে নিজেদের ‘মার্কেটিংয়ের লোক’ বলেই দাবি করে ল্যাব সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু মার্কেটিংয়ের লোক দাবি করলেও হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে ল্যাবে নিয়ে যাওয়াই তাদের কাজ।

আর কোনো রকমে ল্যাবে নিয়ে যেতে পারলেই চলে গলাকাটা ফি আদায়। গতকাল সোমবার দুপুরে এরকম দুজন দালালকে হাতেনাতে আটকের পর পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের এনসিলারি (আউটডোর) ভবনের নিচতলা থেকে তাদের আটক করা হয়। প্রদীপ (৪০) ও দিলীপ (১৭) নামে এই দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করে চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নুরুল আলম আশেক আজাদীকে বলেন, হাসপাতালের পরিচালক মহোদয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের দুজনকে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার (আজ) তাদের আদালতে চালান করে দেয়া হবে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গ্রেপ্তার দুজন জেনেটিক নামে একটি বেসরকারি ল্যাবে কর্মরত। হাসপাতালের ৩৪নং (গাইনী) ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা এক রোগীর স্বজন স্লিপ নিয়ে বের হলে তাকে ফুসলিয়ে নিজেদের ল্যাবে নিয়ে যান তারা। রোগীর ওই স্লিপে সিবিসি ও সিআরপি নামে দুটি টেস্টের কথা লিখে দিয়েছিলেন ওয়ার্ডের চিকিৎসক। ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার পর রোগীর স্বজনের কাছ থেকে এ দুটি টেস্ট বাবদ ১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করা হয়। এর মাঝে সিবিসি টেস্ট বাবদ ৪০০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু ওই ল্যাবের রশিদে সিবিসি টেস্টের জন্য ৫০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। অথচ প্রথম সারির ও পরিচিত ল্যাবগুলোতে এ টেস্টের ফি ৪০০ টাকার বেশি নেয়া হয় না। আর সিআরপি টেস্ট বাবদ ওই রোগীর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৬০০ টাকা। এর বাইরে কালেকশন খাত দেখিয়ে আরো ১০০ টাকাসহ দুটি টেস্ট বাবদ মোট ১ হাজার ২০০ টাকা আদায় করা হয়েছে ওই রোগীর কাছ থেকে। কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হয়নি। তাছাড়া ১ হাজার ২০০ টাকাই এডভান্স হিসেবে আদায় করা হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ল্যাবের লোককে (দালাল) হাসপাতালের স্টাফ ভেবেছিলেন রোগীর স্বজন। যার কারণে তাদের সাথে গিয়ে টেস্টের জন্য ফি পরিশোধ ও স্যাম্পল দিয়ে আসেন। কিন্তু স্যাম্পল দিয়ে হাসপাতালে আসার পর ওই লোককে আবারো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন রোগীর স্বজন। অন্য রোগীর স্বজনদেরও একইভাবে ফুসলাতে দেখেন। তখনই গাইনী ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা ওই রোগীর স্বজনের সন্দেহ হয়। দুজন আনসার সদস্যকে দেখে ঘটনা খুলে বলেন। ওই সময় ওয়ার্ড মাস্টার কামরুজ্জামান ও হাসপাতাল পরিচালকের দেহরক্ষী (রানার) ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হন। ঘটনা শুনে দুজনকে ধরে হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষে নিয়ে যান তারা। নিজ দপ্তর থেকে তৎক্ষনাৎ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জকে ফোন করেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। আটক দুজনকে থানায় সোপর্দ করার নির্দেশনা দেন তিনি। পরে আটক দুজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়।

দালাল নিয়োজিত করা এবং অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে জেনেটিক ল্যাবের পরিচালক (প্রশাসন) তানভির তারেক পাপ্পু আজাদীকে বলেন, তারা দালাল নয়, আমাদের মার্র্কেটিংয়ের লোক। অনেক সময় রোগীদের জরুরি ভাবে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। যা হাসপাতালে করা সম্ভব হয়না। ওই সময় ল্যাবের মার্কেটিংয়ের এই লোকগুলো রোগীদের হেল্প করেন। তবে সরকার নির্ধারিত ফি’র বেশি আদায় প্রসঙ্গে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি ল্যাবটির পরিচালক। তার দাবি, তিনি সবসময় রোগীদের সর্বোচ্চ ছাড় দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু এই রোগীর ক্ষেত্রে বেশি আদায় ও ছাড় না দেয়ার বিষয়টি ঠিক বুঝতে পারছেন না বলেও মন্তব্য জেনেটিক ল্যাবের পরিচালক (প্রশসান) তানভির তারেক পাপ্পুর।

চিকিৎসকদের মানসিকতা পরিবর্তনও জরুরি : সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালের চিকিৎসকরাও বেসরকারি ল্যাবগুলোর টেস্ট বাণিজ্যের সুযোগ করে দিচ্ছেন। গতকাল দালালের খপ্পরে পড়া রোগীর স্লিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্লিপে সিবিসি ও সিআরপি নামে অত্যন্ত কমন দুটি টেস্ট লিখেছেন চিকিৎসক। পাশে ৩০% ডিসকাউন্টও উল্লেখ করে দিয়েছেন। যদিও স্লিপে কোনো ল্যাবের নাম উল্লেখ করা ছিলনা। হাসপাতাল প্রশাসন বলছে, কমন এই দুটি টেস্ট হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে খুবই স্বল্প খরচে করার সুযোগ রয়েছে। সিবিসি ২০০ টাকায় এবং ১৫০ টাকায় সিআরপি টেস্ট করা যায় হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে।

রোগী বা স্বজনকে টেস্টের স্লিপ লিখে দেয়ার সময় চিকিৎসক যদি হাসপাতালের প্যাথলজিতে টেস্ট দুটি করার কথা বলে দিতেন, তবে এই রোগীর স্বজনদের দালালের খপ্পরে পড়তে হতোনা বলে মনে করেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু হাসপাতালের প্যাথলজিতে টেস্ট করতে বলে না দেয়া এবং স্লিপে ডিসকাউন্টের কথা উল্লেখ করার বিষয়টি অনেকটা বেসরকারি ল্যাবে যেতে পরোক্ষ নির্দেশনা বলে মনে করছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। একাধিক চিকিৎসক বলছেন, হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের টেস্টের জন্য বিশেষ করে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ল্যাব নির্ধারণ করে দেয়ার বিষয়টি এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। কোন মাসে কোন ল্যাবে হাসপাতালের রোগীদের টেস্ট হবে, তা নির্ধারণ করে দেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরাই। অন্যদিকে, রোগীরা হাসপাতালের অভ্যন্তরেই টেস্ট করুক, হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসকই যেন তা চান না। হাসপাতালে টেস্ট করতে তারা বিভিন্ন ভাবে রোগীদের নিরুৎসাহিত করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহারেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীই গরীব ও অসহায় পরিবারের। তাদের সবার পক্ষে মোটা অংকের ফি দিয়ে বেসরকারি ল্যাবে টেস্ট করা সম্ভব হয়না। কিন্তু চিকিৎসকদের ইচ্ছের উপর এসব গরীব রোগীরা যেন আরো অসহায় হয়ে পড়েন।

তাই ইন্টার্ন ও চিকিৎসকদের মানসিকতা পরিবর্তন না হলে হাসপাতালে দালালের উৎপাত এবং বেসরকারি ল্যাবগুলোর টেস্ট বাণিজ্য সহসাই বন্ধ হবার নয় বলে অভিমত স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের। দালালের উৎপাত বন্ধে চিকিৎসকসহ সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান। তিনি আজাদীকে বলেন, সব পক্ষের সহযোগিতা ছাড়া দালালের উপদ্রব বন্ধ করা সহজ নয়। তবে চিকিৎসকদের এক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসালেহ কার্পেট মিলস গুদাম দেখভালে রিসিভার নিয়োগ আদালতের
পরবর্তী নিবন্ধহারাতে না পারার চক্রে বন্দি জব্বারের বলী খেলা