করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহেও গতি ফিরছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৩ হাজার ৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এ বছর আগস্টে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। মহামারীর অভিঘাতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে এসেছিল। এরপর টানা তিন মাস অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকল। অপরদিকে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেশ কমেছে। সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪৯৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের মেষ মাস জুনে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। খবর বিডিনিউজের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, টানা প্রায় ১০ বছর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্ক বা ১০ শতাংশের উপরে ছিল। তবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো তা ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ধারাবাহিকভাবে এই প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে গত এপ্রিলে ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ওই মাসে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে যায়। গত জুনে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহে ১৬ দশমিক ৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের মুদ্রানীতিতেও এই একই লক্ষ্য ধরা ছিল, বিপরীতে ঋণ বেড়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।
কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকার সোয়া লাখ কোটির টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক ও ব্যাংকাররা। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মহামারীর ধাক্কা আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করেছে। রেমিটেন্স, রপ্তানি আয়, রাজস্ব আদায়ের পাশপাশি অর্থনীতির অন্যান্য সূচকগুলোও ইতিবাচক ধারায় ফিরছে। প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। সব মিলিয়ে অর্থনীতি ঘুঁরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তাই বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে।
২০০৭-০৮ মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক হচ্ছে বেসরকারি ঋণ। সেই ঋণ যদি না বাড়ে তাহলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে না। কাঙ্খিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সামপ্রতিক সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির বড় কারণ হচ্ছে প্রণোদনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপ থাকায় ঋণ বিতরণ বাড়ছে। আবার ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত টাকা থাকায় ব্যাংকাররাও চাচ্ছে ঋণ বাড়ুক। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও ঘুরে দাঁড়াতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। অর্থনীতির জন্য এটা ভালো খবর। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।