: বুঝলে, আমরা হলাম ‘বেলা’ যুগের সংগীতশিল্পী।
: ‘বেলা যুগ’? এ আবার কোন যুগের কথা?
: চট্টগ্রামের মানুষ তখনও গিটার চেনে না। আমরা যখন স্প্যানিশ গিটার, লিড গিটার বাজাই, তখনও এই গিটার সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। তখন বাদ্যযন্ত্র বলতে চিনতো বেহালা, সরোদ, সেতার, হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি। আর আমরা যখন গিটার বগলতলে, কাঁধে নিয়ে রাস্তা দিয়ে যেতাম, তখন এলাকার মানুষজন বলতো: “ঐ চা, ‘বেলা’ বাজাইবার যার।”
‘বেলা’ মানে বেহালা। গিটার ঐ সময়ের মানুষের কাছে ‘বেলা’ নামেই পরিচিত ছিল। আর আমরাও মজা পেতাম। তো, সেজন্যই বললাম, আমরা ‘বেলা’ যুগের সংগীতশিল্পী। আর সময়টা ছিল ১৯৭২ সাল।
এভাবেই আলাপচারিতায় মেতে উঠলাম মমতাজুল হক লুলু ভাইয়ের সাথে। তিনি ছিলেন সেই স্বাধীনতা উত্তরকালে চট্টগ্রামে নতুনধারার সংগীত যাত্রার অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী। সুরেলা এবং সোলস–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৭২ সালে সাজেদ উল আলম ও মমতাজুল হক লুলু–এই দুইজনের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা সংগীতদল “সুরেলা”–যা পরবর্তীতে রূপ নেয় “ সোলস” নামে। আজ “সোলস” বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ও জনপ্রিয় ব্যান্ড। ৫২ বছর পেরিয়ে এখনো সক্রিয় সোলস। সেই সোলস–এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মমতাজুল হক লুলু আজও গানের মধ্যেই আছেন। গানের সুর শুনেই বলে দিতে পারেন–কোন গানটা জনপ্রিয় হবে, শ্রোতাদের মনে দাগ কাটবে।
মমতাজুল হক লুলুর পরিবারে গান–বাজনার রেওয়াজ ছিল। দেশ স্বাধীনের আগের কথা। ঐ সময়ে বাসায় যেহেতু বড় বোনেরা গান গাইতেন, গানের প্রতি সহজাত একটি আগ্রহ তৈরি হয়। তবে লুলু গান গাইবার চাইতে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। প্রথমে বাজাতেন হারমোনিয়াম।
পরবর্তীতে ব্যানজো, হাওয়াইন গিটার, একোডিয়ান বাজানো শিখলেন। তবে কোন ওস্তাদজীর কাছে নয়। রেডিওতে গান শুনে শুনে বাজাতেন। আর এভাবেই লুলুর সংগীতের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।
১৯৭২… দেশ স্বাধীনের পরের বছর। খুব সম্ভবতঃ মার্চ–এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের জামাল খান রোডে সেন্ট মেরী’স স্কুলের অডিটোরিয়ামে “লাইটিনিংস” নামে একটি ব্যান্ডের গান শুনতে গেলেন বন্ধু মইনুল হক মইনকে নিয়ে। পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের বাজনা ও গান, সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট অনুষ্ঠান। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা করলেন এভাবে: দারুণভাবে শিহরিত হলাম “লাইটিনিংস” এর অনুষ্ঠান দেখে। ড্রাম সেট, গিটার, একোডিয়ান বাজানো দেখে চমৎকৃত হলাম। অনুষ্ঠান শেষ হলে আমার সাথে থাকা বন্ধু মইনের মাধ্যমে পরিচয় হলো সাজেদ উল আলমের সাথে। সাজেদ ও মইন আবার স্কুল বন্ধু। যা হোক, সেই রাতে সাজেদের সাথে পারস্পরিক আলাপে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর বিষয়টি উঠলো। সাজেদকে নিয়ে আমি মোমিন রোডে আমাদের বাসায় আসলাম। তাকে হারমোনিয়াম ও ব্যানজো বাজিয়ে শোনালাম। শুনে সাজেদও দারুণ উৎসাহিত হলো। পরে সাজেদ আমায় তাদের কাজির দেউড়ির বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে তার বাদ্যযন্ত্র ছিল পুরোনো একটি একোডিয়ান, তবলা। এগুলো দিয়েই আমরা বাজালাম। একসময়ে সাজেদ ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা একটি বাদ্যযন্ত্রের দল গড়বো। রাত তখন দশটা হবে। আমরা তখন দারুণ উত্তেজিত। নতুন কিছু গড়বো। সাজেদ তার বাবা প্রখ্যাত সাহিত্যিক মাহবুব উল আলমের কাছে গেল এবং একটি বাদ্যযন্ত্রের দল গঠনের ইচ্ছের কথা বললো, সেসাথে দলের জন্য একটি নাম চাইলো। সবশুনে মাহবুব উল আলম সম্মতি দিলেন এবং দলের জন্য নাম বললেন: “সুরেলা”। ব্যস, একরাতের মধ্যেই আমাদের অনেক কিছু হয়ে গেল। লাইটিনিংস–এর ঐ অনুষ্ঠানের পর আমাদের দেখা হওয়া, বাসায় গিয়ে বাদ্যযন্ত্র বাজানো, দল গঠনের পরিকল্পনা ও “সুরেলা” নামে দল গঠন
–সবমিলিয়ে দারুণ রোমাঞ্চকর। আর এভাবেই সাজেদ ও আমার সংগীতের সঙ্গে একত্রে যুক্ত হওয়া।
পরবর্তী সময়ে এই সুরেলা দলে যুক্ত হলেন তৌহিদ উল আলম, এনায়েত করিম, সুব্রত বড়ুয়া রনি। আমরা ঐ সময়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে, স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজাতে যেতাম। আমাদের আমন্ত্রণ করা হতো। তবে সাজেদ ও আমার “সুরেলা”–র হয়ে প্রথম অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি “সূচনা” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে। “সূচনা”র যাত্রা শুরু হয় আমাদের বন্ধু শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর বাসা থেকেই। ‘সূচনা’ রবীন্দ্র–নজরুল জয়ন্তী আয়োজন করে। আর অনুষ্ঠানটি হয়েছিল রহমতগঞ্জ এলাকায় সিএন্ডবি মিলনায়তনে। আমাদের বাদ্যযন্ত্র ছিলো শুধুমাত্র একোডিয়ান ও ব্যানজো। সুচনা’র মাধ্যমেই কিন্তু সুরেলা’র যাত্রা শুরু। তারপর তো সুরেলা অনেক অনুষ্ঠানে বাজিয়েছে। আমরা সেই সময়ে দেশাত্মবোধক গান, বাংলা আধুনিক গানের সুর বাজাতাম। সেই সুর আবার রেডিও থেকে শুনে শুনে বাজাতাম। এখন তো এসব কেউ ভাবতেই পারবে না। ১৯৭২ সালে “সুরেলা” চট্টগ্রাম ক্লাবে অনুষ্ঠান করার আমন্ত্রণ পায়। সেই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আমাদের বিশাল অভিজ্ঞতা হলো। প্রথমদিকে ঐ সময়ে সুরেলার লাইনআপ ছিল এমন: সাজেদ, রনি, তৌহিদ ও আমি। এনায়েতের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সেও কিছুদিন যুক্ত ছিল সুরেলা’র সাথে। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতো বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। আমি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজাতাম। স্কুলে, ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ পেতাম। সব মিলিয়ে ১৯৭২ সালে “সুরেলা” ভালোই যাত্রা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে তপন চৌধুরী যোগ দিলে, ঐ সময়ে “সুরেলা” গানও পরিবেশন করতো অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে আমরা পিংক কালারের শার্ট ও কালো রঙের প্যান্ট পরতাম। এটাও দর্শক শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো।”
এভাবেই চলছিল। একদিন এই স্বপ্নবাজ তরুণেরা আরও নতুন কিছু একটা করার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। প্রখ্যাত সাংবাদিক মইনুল আলমের ব্যবসায়ী বন্ধু ওয়াদুদুল ইসলাম দুই দফায় ইংল্যান্ড ও ভারত থেকে নিয়ে এলেন ড্রাম সেট, লিড গিটার, বেস গিটার, রিদম গিটার, এমপ্লিফায়ার। এবার “সুরেলা” পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্র পেয়ে আরও আধুনিকতার খাতায় নাম লেখালো। নতুন বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয় আর গান নিয়ে নতুনত্বের স্বাদ দিতে মরিয়া এই গান পাগলের দল।
মমতাজুল হক লুলু এই বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে বললেন: আসলে আমরা তখন দলকে আরও আধুনিকভাবে উপস্থাপন করার চিন্তা করছিলাম। ঐ সময়ের আমাদের উপস্থাপন ও চিন্তাভাবনার সাথে “সুরেলা” নামটি যথাযথ হচ্ছিল না। পাশ্চাত্য ধাঁচের নামের প্রতি আমাদের আগ্রহ হলো। দশটি নাম দিলেন সাংবাদিক মইনুল আলম। ওখানে একটি নাম ছিল-THE SOULS. পরে চূড়ান্ত হলো THE বাদ দিয়ে শুধু SOULS… এই নামটি পছন্দ করে দিলো ফরিয়াদুল ইসলাম। বলা যায়, ১৯৭৩ সাল থেকেই এভাবে আমাদের নতুন যাত্রা, নতুন আঙ্গিকে। ইংরেজি গান গাইবার অনুরোধ আসতে থাকায় একটু দুশ্চিন্তায় পরে যাই। পরে রনি সেই সমস্যার সমাধান করে দেয়। পাথরঘাটাবাসী লরেঞ্জো পল ও রুডি থমাস–এদের নিয়ে এলো রনি। ওরা দুইজনই গিটার বাজানো ও ইংরেজি গান গাইতে পারতো। ব্যস, এবার বাংলা ও ইংরেজি গান পরিবেশন ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোয় নতুনভাবে গড়ে ওঠে SOULS… আমি লিড গিটার, একোডিয়ান, ব্যানজো বাজাতাম। লিড গিটারে সুর তুলতে বেশ কষ্ট হতো। আমাকে ঐ সময়ে দারুণভাবে সহায়তা করেছিলেন দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক তসলিম উদ্দিন চৌধুরী। তসলিম ভাই বিদেশী সংগীত বিষয়ক বিভিন্ন ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতেন। তিনি নিজেও একজন সংগীতানুরাগী। আমাকে সুরের কর্ড ধরিয়ে দিতেন। আমিও নিয়মিত চর্চা করতাম। সাজেদের বাসাতেই আমরা চর্চা করতাম বেশীসময়। আমার বাসায়, রনির বাসাতেও চর্চা করতাম আমরা। আর ঐ সময়ে গিটার নিয়ে যাবার সময়ে আমাদের বলা হতো : “বেলা বাজানোর দল। এ এক মজার স্মৃতি।”
১৯৭৪ সালে মমতাজুল হক লুলুর বাবা এবং মা ইন্তেকাল করেন। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। ঐ সময়ে আর দলকে সময় দেওয়া, নিয়মিত চর্চা করা, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা ইত্যাদি কঠিন হয়ে পড়ে। নিজ থেকেই সোলস থেকে বিদায় নিলেন। ১৯৭৫ সাল থেকে আর সোলস–এর সাথে যুক্ত থাকলেন না। কিন্তু সেই ভালো লাগার গানের দল “সোলস” আজও লালন করেন তিনি। যোগাযোগ রাখেন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের সাথে।
সোলস–এর ৫০ বছর পূর্তি হয়ে গেল। চট্টগ্রামে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হলো। সেই অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে সংবর্ধিত হলেন মমতাজুল হক লুলু। যাঁদের হাত ধরে সোলস–এর প্রতিষ্ঠা, সোলস–এর বর্তমান শিল্পীরা মনে রাখায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লুলু বললেন: এ আমার পরম সৌভাগ্য। পার্থ বড়ুয়ার একাগ্রতায় আজ সোলস ৫০ বছর পেরিয়ে এসেছে। এরমধ্যে অনেক শিল্পীর আসা–যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও টিকে আছে। মূলতঃ ভিত্তিটা মজবুত ছিল, মৌলিক গানের শুরুটাও শক্তিশালী ছিল। অনেক মেধাবী শিল্পীর সমন্বয় ছিল। যে কারণে সোলস আজও আছে। এ পর্যন্ত যত শিল্পী যুক্ত ছিলেন, সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা।”
এখনও মমতাজুল হক লুলুর অবসরে গান শোনার বাতিকটা রয়ে গেছে। নতুন গান রিলিজ হলেই শোনেন। এক্ষেত্রে তাঁর বন্ধু শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর কথা উল্লেখ করেন। বন্ধুর লেখা নতুন গান রিলিজ করলেই লুলুকে পাঠান তিনি। বন্ধুর লেখা গান আবিষ্টমনে শোনেন লুলু। গানের মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করেন। আলোচনা করেন প্রিয়জনদের সাথে।
আজও মমতাজুল হক লুলু হেঁটে চলেন প্রিয় চট্টগ্রামের বিভিন্নপথে। যেখানে মিশে আছে মিষ্টি–মধুর স্মৃতি। আর মনে মনে গুনগুন করেন প্রিয় বন্ধু শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখায় পার্থ বড়ুয়ার সুরে ও কণ্ঠে এই গানটি–
দখিনা হাওয়া ঐ তোমার চুলে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় এলোমেলো করে
কয়েকটি চুল ঢেকে যায়
তোমার একটি চোখ
আমি ভুলে যাই, তুমি আমার নও।।











