বেবি-বুমার প্রজন্ম :‘ফিফটি ফাইভস্‌’ দ্য প্রবলেম জেন

এম. এ. মুকিত চৌধুরী | সোমবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান বিশ্বে এবং বাংলাদেশেও সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ধারায় নতুন প্রজন্মের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা শোনা যায়। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণা ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় উঠে এসেছে একটি ভিন্ন চিত্র ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বের মানুষ, বিশেষ করে বেবিবুমার প্রজন্ম, যাঁরা অবসর জীবনযাপন করছেন, তাঁদের আচরণ এবং মানসিকতার কারণে সমাজে নতুন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

জেনারেশন এক্স এবং জেডএর তুলনায় বেবিবুমাররা প্রযুক্তি এবং আধুনিক জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে তুলনামূলকভাবে কম সক্ষম। যেখানে জেনারেশন এক্স প্রথাগত মূল্যবোধ এবং আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে অগ্রসর হয় এবং জেনারেশন জেড দ্রুত উদ্ভাবনী ধারণা গ্রহণে দক্ষ, সেখানে বেবিবুমারদের মধ্যে পরিবর্তনের প্রতি অনাগ্রহ এবং পুরনো অভ্যাস ধরে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। এই প্রেক্ষাপটেই তাঁদের মানসিকতা এবং আচরণ কীভাবে বর্তমান প্রজন্ম এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।

৫৫+ বা বেবিবুমার প্রজন্ম

বেবিবুমার প্রজন্ম বলতে ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী মানুষদের বোঝানো হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীজুড়ে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা ‘বেবি বুম’ নামে পরিচিত। এই প্রজন্মটি একসময় সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের চালক ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে তাঁদের অনেকেই অবসরে গিয়েছেন এবং তাঁদের পুরোনো চিন্তাভাবনা ও অভ্যাস অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের সাথে খাপ খাচ্ছে না।

কেন তাঁরা ‘নতুন সমস্যামূলক প্রজন্ম’?

. পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি: বেবিবুমার প্রজন্মের একটি বড় অংশ প্রযুক্তি এবং আধুনিক জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে আগ্রহী নন। বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং, কমার্স বা আধুনিক কর্মসংস্থানের ধারণা তাঁদের কাছে অনেক সময় দুর্বোধ্য মনে হয়। ফলে তাঁরা নতুন প্রজন্মের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব দিতে চান না।

. পরিবেশগত দায়িত্ববোধের অভাব: বেবিবুমার প্রজন্মের অনেকেই পরিবেশগত সচেতনতার দিকে মনোযোগ দেননি। তাঁদের সময়ে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিল প্রাধান্য পেয়েছে, কিন্তু এর ফলে যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, তা উপেক্ষিত হয়েছে। বর্তমানে যখন পরিবেশ রক্ষার জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তখন এই প্রজন্মের অনেকেই সেই পরিবর্তনকে সঠিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না।

. স্বাস্থ্য ও অভ্যাসজনিত সমস্যা: এই প্রজন্মের অনেকেই ধূমপান, মদ্যপান এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের মতো সমস্যাগুলোর সাথে বড় হয়েছেন। যদিও বর্তমান প্রজন্ম স্বাস্থ্য সচেতন, তবু এই অভ্যাসগুলো বুমার প্রজন্মের মধ্যে রয়ে গেছে এবং তাঁদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও চিকিৎসা খরচ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও এই সমস্যা ব্যাপক। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পুরো স্বাস্থ্যখাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।

. আর্থিক দায়বদ্ধতার অভাব: বেবিবুমার প্রজন্ম অনেক সময় তাঁদের সন্তানদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশে এমন বহু পরিবার রয়েছে, যেখানে বয়স্ক পিতামাতার ভরণপোষণের জন্য মধ্যবয়সী সন্তানদের কষ্ট করতে হয়। অথচ তাঁদের অনেকেই অবসরের সময়কালে পর্যাপ্ত সঞ্চয় করেননি বা অবসরকালীন পরিকল্পনা করেননি।

জেনারেশন এক্স এবং জেনারেশন জেডের তুলনা বেবিবুমার প্রজন্মের সাথে জেনারেশন এক্স (১৯৬৫১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণকারী) এবং জেনারেশন জেড (১৯৯৭২০১২ সালে জন্মগ্রহণকারী) এর তুলনায় দেখা যায় যে, এই নতুন প্রজন্মগুলো পরিবর্তন এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে সক্ষম।

জেনারেশন এক্স:

জেনারেশন এক্সকে বলা হয় ‘ট্রানজিশনাল জেনারেশন’। এই প্রজন্মটি বেবিবুমারদের মতো পুরোনো অভ্যাস নিয়ে বেড়ে উঠলেও ধীরে ধীরে প্রযুক্তির সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে। তাঁরা বর্তমানে কর্মজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এবং প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা কার্যক্রম এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনকে দ্রুত গ্রহণ করছেন।

জেনারেশন এক্স প্রজন্মের মানুষরা সাধারণত প্রথাগত মূল্যবোধ এবং আধুনিকতা উভয়ের সাথেই সংযোগ রক্ষা করেন। তাঁদের মধ্যে উদ্ভাবনী ক্ষমতা রয়েছে, তবে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁরা কিছুটা ধীর। এই প্রজন্মের একটি বড় সুবিধা হলো তাঁরা সমস্যার সমাধানে প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন এবং পরিবর্তনকে শর্তসাপেক্ষে মেনে নিতে প্রস্তুত থাকেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জেনারেশন এক্সের একটি বিশেষ দিক হলো, তাঁরা মূলত কর্মজীবী মধ্যবয়সী জনগোষ্ঠী, যাঁরা দেশের অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি। তাঁরা পরিবার ও কর্মক্ষেত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেন এবং নতুন প্রযুক্তি ও ধারণাকে সাবলীলভাবে গ্রহণ করতে পারেন। তবে অনেক সময় তাঁদের মধ্যে বেবিবুমারদের মতো কিছু প্রতিরোধ মনোভাবও দেখা যায়, বিশেষত পরিবর্তনকে দ্রুত মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে।

জেনারেশন জেড:

জেনারেশন জেড প্রযুক্তির যুগে জন্ম নেওয়া একটি প্রজন্ম। তাঁরা ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে বেড়ে উঠেছেন। এই প্রজন্ম অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তন গ্রহণ করে এবং নতুন ধারণাকে সহজে গ্রহণ করতে পারে। তাঁরা পরিবেশ সচেতন, স্বাস্থ্য সচেতন এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন উপায় খোঁজে।

জেনারেশন জেডএর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো তাঁদের উদ্যোক্তা মনোভাব। তাঁরা চাকরির পরিবর্তে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে এবং ঝুঁকি নিতে আগ্রহী। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাঁরা ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ এবং ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মতো ক্ষেত্রগুলোতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। তাঁরা ক্যাশলেস সোসাইটির ধারণা গ্রহণ করছে এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী।

বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং চ্যালেঞ্জ

বেবিবুমার প্রজন্মের সাথে ব্র্যান্ডিং ও মার্কেটিং সংক্রান্ত বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

. ডিজিটাল পদ্ধতিতে কম আগ্রহ: বাংলাদেশের বেবিবুমাররা এখনও প্রথাগত পদ্ধতিতে কেনাকাটা এবং সেবাগ্রহণে অভ্যস্ত। তাঁদের মধ্যে অনলাইন কেনাকাটার প্রবণতা খুবই কম, যা ইকমার্স ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধক।

. বিশ্বাসের ঘাটতি: নতুন প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের প্রতি তাঁদের মধ্যে বিশ্বাসের অভাব রয়েছে। তাঁরা ক্যাশলেস লেনদেনের পরিবর্তে নগদ অর্থ ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, যা ক্যাশলেস ইকোনমি গঠনে বাধা সৃষ্টি করছে।

. মার্কেটিং কৌশলে ঐতিহ্যের গুরুত্ব: এই প্রজন্মের জন্য ব্র্যান্ডিং এবং বিজ্ঞাপনে তাঁদের সময়ের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে স্থান দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক এবং গতিশীল বিজ্ঞাপন কৌশল তাঁদের কাছে অনেক সময় দুর্বোধ্য মনে হয়। ফলে বিজ্ঞাপন বার্তাগুলো তাঁদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।

. স্বাস্থ্য ও জীবনধারা কেন্দ্রিক পণ্য: বেবিবুমারদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, ঔষধ, এবং জীবনধারা ভিত্তিক পণ্যের সঠিক ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব রয়েছে। এই ক্ষেত্রে তাঁদের জন্য পৃথক মার্কেটিং কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।

সমাধানের দিকনির্দেশনা

. বয়স্ক জনগোষ্ঠীর চাহিদা বোঝা: তাঁদের মানসিকতা এবং জীবনধারার প্রতি সংবেদনশীল থেকে মার্কেটিং কৌশল তৈরি করতে হবে।

. উপযুক্ত প্রযুক্তি শিক্ষা: বেবিবুমারদের প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতন করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

. বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি: তাঁদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রমাণিত এবং সহজবোধ্য পদ্ধতিতে পরিষেবা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

. বিভিন্ন মিডিয়ার ব্যবহার: প্রচারমূলক কার্যক্রমে টেলিভিশন, রেডিও এবং স্থানীয় সংবাদপত্রের মতো প্রথাগত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে তাঁদের কাছে পৌঁছানো যেতে পারে।

বেবিবুমার প্রজন্ম একসময় সমাজের গুরুত্বপূর্ণ চালক ছিলেন, কিন্তু বর্তমান সময়ে তাঁদের মানসিকতা এবং অভ্যাস নতুন প্রজন্মের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে এই প্রজন্মের আচরণগত পরিবর্তন আনতে পারলে দেশ দ্রুত উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। তাই এই প্রজন্মকে সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করাই হবে আমাদের আগামী দিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য।

জেনারেশন এক্স এবং জেডের উদ্ভাবনী মনোভাব থেকে শিক্ষা নিয়ে বেবিবুমার প্রজন্মের আচরণগত পরিবর্তন ত্বরান্বিত করা সম্ভব। সমাজের প্রতিটি প্রজন্মের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারলেই একটি উন্নত ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, স্ট্র্যাটেজিক সেলস, এলিট পেইন্ট এন্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতমদ্দুন মজলিস ও ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধমাওলানা আশরাফ আলী শাহর বার্ষিক ওরশ আজ