বেড়ে চলেছে মানুষে মানুষে হিংসা-বিদ্বেষ-দ্বন্দ্ব : প্রয়োজন উত্তরণ

এম আনোয়ার হোসেন | মঙ্গলবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৮:৩৪ পূর্বাহ্ণ

. মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। স্রষ্টার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষের রয়েছে ভিন্ন গুণ। যেমন, আহার শক্তি, বাক শক্তি, যৌবন শক্তি এবং ভুলে যাওয়া অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ভুলে না গেলে মৃত্যু, কবর ও জাহান্নামের ভয়ে মানুষ সংসার ছেড়ে দিয়ে পাগল হয়ে যেত। আবার আহার শক্তি ও যৌন শক্তি স্রষ্টার অন্যতম সৃষ্টি ফেরেস্তাদের নেই। যদিও জীন জাতির সেটা রয়েছে। অবশ্য বিজ্ঞান অদ্যাবধি জ্বীন জাতির অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেনি। কিন্তু স্রষ্টা মানুষকে বিবেক বা জ্ঞান শক্তি, ইচ্ছা শক্তি, আহার শক্তি, যৌবন শক্তি, চমৎকার মানব দেহ, গঠন, শৃঙ্খলা শক্তি, চমৎকার বৈবাহিক সম্পর্ক, আচারব্যবহার দান করেছেন। এ সব স্রষ্টার অন্য কোনো সৃষ্টির মধ্যে একত্রে পাওয়া যাবে না। তাই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের যেমন রয়েছে বিবেকবুদ্ধি, যৌন চাহিদা ও বংশ বৃদ্ধির ক্ষমতা। তেমনি আছে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা। ফলে মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অন্যকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। বনের পাগলা হাতি, ঘোড়া থেকে শুরু করে আকাশে উড়ন্ত ফ্লাইটও নিয়ন্ত্রণ করে একমাত্র মানুষ। বিস্ময়কর আবিষ্কার ইন্টারনেট, মোবাইলের আবিষ্কারকও মানুষ। যার মাধ্যমে মানুষ ইউরোপ আমেরিকার ওপার থেকে এশিয়ার এ প্রান্তে সেকেন্ডের মধ্যে কথা বলতে, দেখে কথোপকথন কিংবা ভাব বিনিময় ও ডকুমেন্টস আদান প্রদানের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। তেমনি মানুষের সৃষ্টি পারমাণবিক শক্তিরও আবিষ্কারক। এ কারণে পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে প্রায় স্নায়ু যুদ্ধ বিরাজমান থাকে। বিষ্ময়কর স্রষ্টার বিস্ময়কর সৃষ্টি মানুষের এ সব অভাবনীয় সৃষ্টি। ফলে মানুষ অতি আধুনিক সভ্যতার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। মানুষ এক জায়গায় বসেই প্রায় সমস্ত কাজ সম্পন্ন করছে। ডিজিটালইজ পৃথিবীর মানুষগুলো যেন অবাধ স্বাধীনতা উপভোগ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় মানুষ অনেক সময় রোবটে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। স্রষ্টার অসংখ্য অপুর্ব সৃষ্টির মধ্যে মানব সমাজে মানুষের জয় যেন শীর্ষ ছুড়ায় পৌঁছে গেছে।

. মানুষের আবিষ্কারের ফলে যেমন মানুষের অভাবনীয় সুযোগ সুবিধা বিরাজমান তেমনি মানুষের ইর্ষা, হিংসাবিদ্বেষ, দখলবাজি, সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব নিদারুণ ভাবে বৃদ্ধি ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের জীবনের মূল্য যেন আদিম, অসভ্য যুগকেও হার মানিয়েছে। শুধুমাত্র গাজা, ইউক্রেনে নয়। গোটা পৃথিবীব্যাপি যেন জোর যার মুল্লক তার নীতি অনুসরণে এগিয়ে চলেছে। মানুষের মধ্যে মনুষ্যবোধ হারিয়ে গেছে। অপরের জীবন নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা করার সময় নেই। মানুষ শুধু নিজের চরকায় তেল দিতে ব্যস্ত। মানব সমাজে মানুষ নিজেকে, নিজের পরিবারকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। হয় নিজের শক্তিমত্তা প্রকাশ, প্রচার, বৃদ্ধি নতুবা নিজের পরিবার, নিজের সমাজ, নিজের দেশ নিয়েই এগিয়ে যায় ও ব্যস্ত সময় কাটান। কিন্তু নিজের ঘরের পার্শ্ববর্তী পরিবার, পার্শ্ববর্তী সমাজ, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের কী হবে সেটা নিয়ে ভাবার ফুরসত নেই। আধুনিক সভ্য সমাজে মানব সমাজের অধিকন্তু মানুষ এর বাইরে নয়।

. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানুষের ওপর চলছে অকথ্য নির্যাতন, নিঃষ্পেষণ। ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি ঘটে চলেছে। মিয়ানমার, ইউক্রেন, গাজা, রাফা, লেবানন, সিরিয়া, রাশিয়া, ইসরায়েল অন্যতম। এ সব দেশে প্রকৃতপক্ষে মানুষ চলছে এক দুর্বিষহ জীবন নিয়ে। এক সেকেন্ডের তাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই, ভরসা নেই। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। নাগরিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমাদের মত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মানুষগুলোর মধ্যে এই প্রবনতা দিন দিন বৃদ্ধি ঘটেছে। চলতি বছরের ৫ আগষ্টের পর মানুষ ভেবেছিল একটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র গঠনে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে। বিভিন্ন কারণে কিন্তু আপাতত তা সম্ভব হয়নি। যদিও প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। মানুষের মধ্যে লোভলালসার প্রবণতা এত বৃদ্ধি ঘটেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ আমাদের দেশে নতুন স্বাধীনতা অর্জনের পরেও মানুষে মানুষে হিংসাবিদ্বেষ চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজপথ ব্যস্ত হয়ে গেছে। যেন ঘরের সমস্যাটিও রাজপথে নিয়ে যেতে পারলেই হল। মানুষ নিজের মতামতকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অন্যকে থোড়াই কেয়ার করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা প্রাধান্য দেয়া হয় তাও নিজের স্বার্থের কথা ভেবে। মানুষের মধ্যে হাইওয়ানি চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটেছে। বাজার দখল, ঘাট দখল, পুকুর দখল ইত্যাদি দখলবাজিতে চলে গেছে। তারা আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ভাগাভাগি, লুটপাটের দৃশ্যের অবতারণা করছে। প্রায় জায়গায় আন্দোলনসংগ্রামের অগ্নি শিখা প্রজ্বলিত হচ্ছে। যে সমস্যার সমাধান হতে লাগবে পাঁচ বছর সেই সমস্যার সমাধান যেন এক রাতেই সমাধান করে দিতে হবে। এমন ভাব ও কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এ সব চলতে থাকলে সাধারণ মানুষের জীবনে কখনো নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের চর্চা হয় না। মানুষের ন্যায্য অধিকার বা হক কিংবা ন্যাযা পাওনা কখনো আদায় হয় না এবং সুরক্ষিত হয় না। নাগরিক ও মানবাধিকার ভুলুণ্ঠিত হয়। সাধারণ মানুষ কখনো শান্তি খুঁজে পায় না। যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং নিজেদের সরকারের শাসন চলমান থাকবে ততক্ষণ তারাই সুখের দেখা পাবে। নিরাপত্তা ও নিরাপদ জীবন উপভোগ করবে। আবার ক্ষমতা চলে গেলে তাদের চেয়ে নি:গৃহীত, নির্যাতিত আর কেউ থাকবে না। এমন জীবন তো কারো কাম্য নয়।

. মানবসমাজে শান্তি আনা, শান্তি বিরাজমান করা খুব কঠিন ব্যাপার। পারমাণবিক শক্তিতে বিরাজমান পৃথিবীর শান্তি বিনষ্টের প্রধান কারণ পারমানবিক শক্তি হলেও অন্যান্য বিধ্বংসী গোলা বারুদ ও মারণাস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত কার্যকরী পদক্ষেপ ও কার্যকরী উদ্যোগই পারে মানব সমাজে শান্তি আনতে। শান্তি বজায় রাখতে নিজেদেরকে সাম্রাজ্যবাদী ও দখলদারিত্ব মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে। উগ্রপন্থা পরিহার করতে হবে। আর আমাদের দেশে সাম্প্রতিক উদ্ভুত পরিস্থিতি উত্তরণের ক্ষেত্রে আইনের শাসন জরুরি। আইন যেন কেউ হাতে তুলে না নেয়। এ জন্যে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্চণীয়। সমাজের, রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও ন্যায় পরায়ণ মানুষের নেতৃত্ব দানে আগ্রহী হতে হবে এবং সুযোগ রাখতে হবে। তেমনি এঁদেরকে সম্পৃক্ত করা দরকার। সংস্কারের উদ্দেশ্য হোক দেশকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়া। দুর্নীতিমুক্ত ও ন্যায় পরায়ণ ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পাঠে দুর্নীতি, সৎ ও ন্যায় পরায়ণ মানুষ সৃষ্টির পাঠ অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্য রাখতে হবে সংস্কার কার্যক্রমে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তি ও ভারসাম্য রক্ষায় আশাব্যঞ্জক ভূমিকাও প্রয়োজন। কর্মের পরিধি বৃদ্ধি করা দরকার। সমাজে যে হারে ডিগ্রি নিয়ে জনবল তৈরি হয় সে হারে কর্ম সৃষ্টি না হলে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে না। এই জনবলের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য স্বপ্ন ভেঙে যায়। জনবল রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহার সম্ভব হয় না। তাই অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি হয়রানি প্রতিরোধ করা না গেলে এবং আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা না গেলে কোনো সংস্কারই মানুষের কল্যাণে আসবে না। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের চাহিদা খুব অল্প। এদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সমাজে স্থিতি থাকে না। সমাজ চলে যায় মুষ্টিমেয় দু:ষ্কৃতকারীদের দখলে। এ সবের কারণে মানুষের প্রধান চাহিদা নিত্যপণ্য দ্রব্য সামগ্রীর বাজার দর সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয় না। এ সব ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। নিজ নিজ অবস্থান থেকে সকলকে সচেতন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা দরকার। দুদিনের দুনিয়ায় অধিকন্তু মানুষ শুধু নিজের সুখ নিয়েই ব্যস্ত। কীভাবে নিজের সন্তান সন্ততিকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানো যায়। সেই চিন্তায় আমরা মশগুল। আমরা কি পারি না, কাজে ব্যতিব্যস্ত মানুষকে একটু সহায়তা করতে! পাশে দাঁড়াতে? আমরা কি পারি না, অসহায় মানুষের হাতে নিজের হাতটা একটু রাখতে! অথচ এই সামান্য হাত রাখার ফলে সমাজে শান্তি আসতে পারে।

লেখক: কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মৃতিতে মাহাতা-পাঠনীকোঠা আর্দশ উচ্চ বিদ্যালয়
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা তহবিল চালু করা সময়ের দাবি