বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ : নারী জাগরণের পথিকৃৎ

মাহবুবা চৌধুরী | মঙ্গলবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে নতুন শামসুন্নাহার হলে কেটেছে আমার দীর্ঘ পাঁচ বছর। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের আবাসিক হোস্টেল ছিল দুইটি। নতুন শামসুন্নাহার হল ও পুরাতন শামসুন্নাহার হল। দেশের দূরদূরান্ত থেকে মেয়েরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে এই দুটি আবাসিক হোস্টেলে অবস্থান করতেন। ঠিক একই নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও মেয়েদের জন্য আছে অনুরূপ একটা আবাসিক হোস্টেল। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অবশ্য নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে হোস্টেলও। কিন্তু জরাজীর্ণ অবস্থায় হলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুটি হোস্টেল সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। আর এই দুটি হোস্টেলের নাম ফলকে ধরে রেখেছে এক অদম্য নারীর ইতিহাস যার নাম বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ।

বিংশ শতাব্দীর এই নারী বেগম রোকেয়া কর্তৃক প্রবর্তিত বাঙালি নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনে একজন সম্মুখ যোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন দেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবিকা। ১৯৪৮ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পুলিশের ব্যারিকেট তছনছ করে দিতে যে ঐতিহাসিক মিছিলটি পথে নেমে এসেছিল আর সেই মিছিলে যে কয়জন নারী ছিলেন, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন তাদেরই একজন। আনুমানিক ১৯ অক্টোবর ১৯০৮, উত্তর গুথুমা গ্রামে, বর্তমানে বাংলাদেশের ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় এই মহীয়সী নারী জন্মগ্রহণ করেন। নারী জাগরণের পথিকৃৎ এই নারীর পিতা মোহাম্মদ নূরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন মুন্সিফ এবং মা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর আবদুল আজিজ ছিলেন তার মাতামহ, আর ফজলুল করিম ছিলেন পিতামহ।

বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের একমাত্র ভাই হাবিবুল্লাহ বাহার ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিক। শিশুকালে অর্থাৎ মাত্র ছয় মাস বয়সে পিতৃহারা হন বেগম শামসুন্নাহার। ভাই হাবিবুল্লাহ বাহারের বয়স তখন ছিল মাত্র তিন বছর।

স্বামীর মৃত্যুর পর মা আছিয়া খাতুন শামসুন্নাহার ও হাবিবুল্লাহ বাহারকে নিয়ে পিতার আশ্রয়ে চলে আসেন। চট্টগ্রামের তামাকুমণ্ডিস্থ নানার বাড়িতে দুই ভাইবোনের শৈশব কৈশোর কাটে। শামসুন্নাহারের মা আছিয়া খাতুনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও লেখাপড়ার প্রতি তিনি ছিলেন গভীর অনুরাগী। তিনি বাংলা পড়তে এবং লিখতে পারতেন। নিজের এই শিক্ষার প্রতি অনুরাগের কারণেই ছেলেমেয়েকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে তিনি উঠে পড়ে লাগেন। কুসংস্কার আচ্ছন্ন অন্ধকার সমাজে বসবাস করেও তিনি শামসুন্নাহারকে লেখাপড়ার ব্যাপারে সর্বদা উৎসাহিত করতেন। শামসুন্নাহারও ছিলেন মায়ের মতোই লেখাপড়ায় অনুরাগী। পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতায়, মা আছিয়া খাতুন ও ভাই হাবিবুল্লাহ বাহারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় বেগম শামসুন্নাহার চট্টগ্রামের ডাক্তার খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু করেন। কিন্তু তখনকার রক্ষণশীল সমাজের অন্ধ প্রথা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে শিক্ষা পরিবেষ্টিত পরিবারে থেকেও ষষ্ঠ শ্রেণিতেই তাঁকে বিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করে। বিদ্যালয়ের পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হলেও, দমে যাননি বেগম শামসুন্নাহার। ঘরে বসেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯২৬ সালে প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে চার বিষয়ে লেটার নম্বর সহ ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি।

১৯২৭ সালে ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সাথে শামসুন্নাহারের বিয়ে হয়ে যায়। ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সার্জন জেনারেল। বেগম শামসুন্নাহার হলেন বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ। ডা. মাহমুদ স্ত্রী শামসুনন্নাহার মাহমুদের শিক্ষানুরাগী মনোভাবকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি আজীবন স্ত্রীর উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতাসহ স্ত্রীর সব কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন। একজন নারীর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে যেমন পরিবারের দ্বায়িত্ব থাকে তেমনি বিয়ের পর স্বামীরও দায়দায়িত্ব থাকে স্ত্রীর ইচ্ছেকে সম্মান ও সমর্থন করা। তবেই সেই নারী কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন, তেমনি একজন ভাগ্যবতী নারী। তিনি স্বামীর সহযোগিতা পেয়েছেন বলেই কুসংস্কারের দুঃস্বপ্ন থেকে বেড়িয়ে একসময় হয়ে ওঠেন বাঙালি নারীর শিক্ষা ও জাগরণের পথিকৃৎ।

বিয়ের পর স্বামী ডা. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের সাথে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ কলকাতায় চলে আসেন। এবং কলকাতার ডায়োসেসান কলেজে ভর্তি হয়। ১৯১৮ সালে তিনি এই কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। এরমধ্যে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। প্রথম সন্তান মামুন মাহমুদের জন্ম ও দেখাশোনার জন্য আবার তাঁর লেখাপড়া স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু কোনো বাধা কি এক অদম্য নারীকে দমিয়ে দিতে পারে। পারে না। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও শুরু করেন পড়াশোনা। ১৯৩২ সালে একই কলেজ অর্থাৎ কলকাতার ডায়োসেসান কলেজ থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে বি এ পাশ করেন। বিএ পাস করার পর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল হাইস্কুল থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। এরপর তিনি বিভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠন ও লেখালেখির কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়েন। দীর্ঘ দশ বছর পর, ১৯৪২ সালে তিনি বাংলা সাহিত্যে তার এমএ সম্পন্ন করেন। পড়াশুনার পর তিনি বেগম রোকেয়ার নেতৃত্বে নারী অধিকার আন্দোলনে যোগ দেন।

বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ও ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের দুই ছেলে, মামুন মাহমুদ ও মাইনুদ্দিন মাহমুদ। মামুন মাহমুদ ছিলেন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি শহীদ হন। মাইনুদ্দিন মাহমুদ, একজন ক্রিকেটার এবং ক্রীড়াপ্রেমী।

শামসুন্নাহার মাহমুদের কর্মজীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। তিনি কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে অধ্যাপক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। তিনি নিখিল বঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতির (অল বেঙ্গল মুসলিম উইমেনস সোসাইটি) সেক্রেটারি হিসাবেও কাজ করেছিলেন।

বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ নিয়মিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতেন। সাথে থাকতেন তার সহোদর ভাই হাবিবুল্লাহ বাহার। কলকাতা থাকাকালীন তিনি ও তাঁর ভাই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক অনুপ্রাণিত হন এবং তখন থেকে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ লেখালেখি শুরু করেন। তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়, ‘আঙ্‌গুর’ পত্রিকায়। আইএ পড়ার সময় থেকেই তিনি ‘নওরোজ’ ও ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকার নারী বিষয়ক অংশের সম্পাদকের কাজ করেন। ১৯৩৩ সালে কলকাতা থেকে শামসুন্নাহার মাহমুদ ও হাবীবুল্লাহ বাহারের সম্পাদনায় বুলবুল প্রকাশিত হয়। পরে এটি মাসিক হিসেবে বের হয়। ‘বুলবুল’ এর মধ্যদিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় তাদের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়মিত বুলবুল সাময়িকী পড়তেন ও লিখতেন। বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বুলবুল পত্রিকাখানি পড়ে আশান্বিত হলুম। সর্বনাশের মদমত্ততায় আত্মবিস্মৃত দেশের উন্মত্ত কোলাহলের মাঝখানে তোমরা শুভবুদ্ধির আহ্বান নির্ভয়ে ঘোষণা কর। ঈশ্বরের প্রসন্নতা তোমাদের শুভবুদ্ধি উদ্যোগকে গৌরাবান্বিত করবে। কৃতজ্ঞ দেশের আশীর্বাদে তোমাদের উদ্যম জয়যুক্ত হোক’।

কাজী নজরুল ইসলাম তার সিন্ধু হিন্দোল কাব্যগ্রন্থ ‘বাহার ও নাহার’কে (হাবীবুল্লাহ বাহার ও শামসুন্নাহার) উৎসর্গ করেন। ১৯৩২ সালে বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর পর তিনি বেগম রোকেয়ার জীবনী রচনা করেন। তৎকালীন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিকরা এ পুস্তকের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

ঢাকায় নারীদের জন্য দুএকটি সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বেগম ক্লাবই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেখানে কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পীদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সমবেত হয়ে সমাজ উন্নয়নবিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও স্বাধীনভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার সুযোগ ছিল। কবি সুফিয়া কামালকে সভানেত্রী ও বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে সাধারণ সম্পাদক করে বেগম ক্লাবের যাত্রা শুরু। পরবর্তী সময়ে এই ক্লাবের হাল ধরেন বেগম সম্পাদক নূরজাহান বেগম। শামসুন্নাহার মাহমুদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলোপুণ্যময়ী ( ১৯২৫), ফুলবাগিচা (১৯৩৫), বেগম মহল (১৯৩৬), রোকেয়া জীবনী (১৯৩৭) বেগম রোকেয়ার প্রথম জীবনী), শিশুর শিক্ষা (১৯৩৯), আমার দেখা তুরস্ক (১৯৫৬) এবং নজরুলকে যেমন দেখেছি (১৯৫৮)

১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বাংলার আকাশ থেকে ঝরে যায় এক সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল নক্ষত্র। পরিসমাপ্তি ঘটে উপমহাদেশের নারী আন্দোলনের একটি অধ্যায়ের।

১৯৮১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে সমাজসেবার জন্য মরণোত্তর স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে মরণোত্তর ‘বেগম রোকেয়া পদক’ প্রদান করা হয়। মৃত্যু কোনো কিছুকে থামিয়ে রাখতে পারে না। যারা এই মহীয়সী নারীর বহুমুখী কাজের সমর্থক ও সহযোগী ছিলেন, তাঁরাই তাঁর উত্তরসূরী হয়ে তৈরি করবেন নতুন পথ, জাগবে নারী, দূর হবে অন্ধকার।

লেখক: কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষাগুরুর শির না হোক নত আর
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ