বাংলাদেশের জনসংখ্যা বাড়ছে হু হু করে। প্রতি ১৩ সেকেন্ডে দেশে একজন জন্মগ্রহণ করছে আর ১৪৪ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। জনসংখ্যার এই উর্দ্ধগতি খুব ভালভাবে টের পাওয়া যায় রাস্তায় বের হলে। শুধু মানুষ আর মানুষ। ফুটপাতে হাঁটার অবস্থা নাই। রাস্তায় অজস্র বাস, ট্রাক, ব্যাক্তিগত গাড়ি, টেক্সি, রিক্সা, মোটর বাইক, স্কুটি মিলে এমন ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করে, একজন ব্যক্তির দিনের একটি বড় সময় কেটে যায় শুধু রাস্তায়।
গাড়ি করে বিজয় স্মরণীর সামনে দিয়ে যাবার সময় জ্যামে থাকা অবস্থাতে আমাদের গাড়ির পিছনে একটি মেয়েকে দেখলাম মোটর সাইকেলের চালকের আসনে বসা। পিছনের আরোহীও একজন মেয়ে। ছোট থেকেই গুলশান, বনানী বা ধানমন্ডীর অভিজাত রাস্তায় নারীদের গাড়ীর স্টিয়ারিং ঘুরাতে হরহামেশাই দেখতে পেতাম। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও মোটর সাইকেল বা স্কুটি চালাচ্ছেন এ দৃশ্য ব্যপকভাবে চোখে পড়ছে গত ৪/৫ বছর হতে। কিন্তু ব্যাপারটা এ পর্যন্ত নয়। এ দৃশ্য যে কারণে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো দুটি মেয়েই বোরকা পরিহিতা। ভালো লাগলো বর্তমান সময়ের নিজে দেখা ঢাকা শহরের এই দৃশ্য।
বোরকা হলো মহিলাদের এক ধরনের পোশাক যা সারা শরীর ঢেকে রাখে। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী পর্দা বজায় রাখার স্বার্থে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম নারীরা ঘরের বাইরে, বিশেষ করে পুরুষমহলে, যাওয়ার সময় এটি পরিধান করে থাকে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন- নারীর শিক্ষাগ্রহণ, নারীর বাইরে চলাফেরা এবং কাজের অধিকার, স্বাধীন চিন্তা-চেতনার অধিকার, এই বিষয়গুলো যে নারীর মুক্তির সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ সেসব কথা বেগম রোকেয়া সারাজীবন বলে এসেছেন।
বেগম রোকেয়া বোরকাকে উন্নতির পথে বাধা হিসাবে দেখেননি। বোরকা পরা নিয়ে বেগম রোকেয়ার সমালোচনা করায় কিঞ্চিৎ ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন –
“তাঁহারা প্রায়ই আমাকে বোরকা ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা উন্নতি লাভ করিয়াছে।”
বোরকা ছাড়াতো বহু দূরের কথা। এর প্রেমে এমনই মশগুল তিনি যে একে আরো কীভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং কারুকার্যময় করা যায় সে বিষয়েও তাঁর চিন্তার কমতি নেই।
রোকেয়ার প্রার্থনা যে কাজে লেগেছে সেটা এখন ঢাকায় রঙ-বেরঙের কারুকার্যময় বোরকা পরিহিত মহিলাদেরকে দেখলেই বোঝা যায়।
পক্ষান্তরে মোটর সাইকেল চালানো নারীদের কাছে একধরণের সখ। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে যেসব নারীরা মোটর সাইকেল চালান তারা ব্যক্তিজীবন, চাকরি জীবন, সংসার জীবন সব ক্ষেত্রেই মোটর সাইকেল না চালানো নারীদের চেয়ে সুখী।
উল্লেখ্য, গবেষণাটি বিখ্যাত মোটর বাইক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হারলে-ডেভিডসনের সহায়তায় কেলটনের তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হয়। গবেষণায় অংশ নেন ১,০১৩ জন নারী বাইকার এবং ১,০১৬ জন যারা বাইক চালান না।
প্রয়োজনের প্রকারভেদে বিভিন্ন বয়সী নারী এখন বাইক চালিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী থেকে চাকরীজীবি এবং প্রফেশনাল বাইকারও আছেন।
বাসা থেকে কর্মস্থলে যাতায়াতের সুবিধার জন্য মোটর সাইকেল কিনেছিলেন সরকারি চাকরিজীবী নাজনীন আক্তার। এতে গণপরিবহন ব্যবহারের ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। পরে সেই বাইক তাঁকে অতিরিক্ত উপার্জনের সুযোগ করে দেয়। কর্মস্থলে আসা-যাওয়ার পথে তিনি এখন ‘রাইড শেয়ার’ করছেন। অর্থাৎ তাঁর মোটরসাইকেলে আরেকজন নারীকে তুলছেন অর্থের বিনিময়ে। রাইড শেয়ারিং করার কারন জানিয়ে তিনি বলেন, অনৈতিকভাবে সরকারী চাকরিতে অর্থ উপার্জন না করে বৈধভাবে অতিরিক্ত আয়ের জন্যেই একাজ করা।
পাঠাও কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের দেড় লাখ চালকের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার নারী। ‘সহজ’-এর সঙ্গে কাজ করছেন অর্ধশতাধিক নারী চালক। পাঠাও’, ‘উবার’ ও ‘সহজ’-এ নারী রাইডাররা নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবার সঙ্গে রাইড শেয়ার করেন। পাশাপাশি ‘ও বোন’ আর ‘লিলি’ নামের দুটি অ্যাপের মাধ্যমে শুধু নারীদের জন্য নারী রাইডারের (চালক) ব্যবস্থা আছে।
তবে এসব কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৯০ শতাংশের বেশি নারী রাইডার খণ্ডকালীন কাজ করেন, আর বাকিরা পূর্ণকালীন। খন্ডকালীন কাজ করে মাসে ৫/৬ হাজার এবং পূর্ণকালীন করে ২৮/৩০ টাকা উপার্জন করা সম্ভব।
স্করপিও কোম্পানির শাহানা পারভীন বলেন, ‘যত কিছুই হোক, বাইক চালাতে আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না। দেড় বছর ধরে বাইক চালাই। রাস্তায় অন্য মেয়েরা আমাদের দিকে তাকিয়ে যখন হাসে, তখন খুব ভালো লাগে। মনে হয় কোনো ভুল করিনি। কোনো ছেলে যখন রেস দিতে চায়, তখন বিরক্ত হলেও কিছু মনে করি না।’ প্রথমে সন্ধ্যার পরে ভয় লাগত, এখন সাহস হয়ে গেছে।
বিভিন্ন প্রয়োজনে মেয়েরা এখন বাইক চালাচ্ছেন। তবে যাঁরা বাইক কিনছেন, তাঁদের বেশির ভাগই সচ্ছল। তাই তারা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে একে ব্যবহার করছেন না। নারী চালকের সংখ্যা না বাড়ার পেছনে এটিও একটি কারণ। শত বাধা সত্ত্বেও কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন, এটাই ইতিবাচক।
পোশাক মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ। সবারই নিজ নিজ পছন্দের শালীন পোশাক পরার অধিকার আছে। তবে শুধু নারীদের কেন, সব মানুষেরই শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পড়া উচিৎ। বন্য পশু পোশাক পরে না, মানুষ পরে, কারণ মানুষ সভ্য। একই সাথে পোশাক মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য। এই স্বাচ্ছন্দ্য স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বদলে যায়।
কেউ যদি মনে করে আমি বোরকা পড়ে বাইক চালাবো এবং এতেই আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছি তবে তাকে তাতেই উৎসাহ দিতে হবে। নিজেকে পূর্ণভাবে পর্দার মাঝে রেখে আধুনিক জীবনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবার সাহস সবার থাকে না।
যুগ যুগ ধরে বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশে মুসলিম নারীদের অবগুণ্ঠনের আড়ালে রাখার চেষ্টা হয়েছে, উন্নয়নের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা হয়েছে। এমন হাজারো বাধা পেরিয়ে নারী এগিয়ে যাচ্ছেন।
সুতরাং মনে যদি থাকে অদম্য ইচ্ছা শক্তি, থাকে জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার লক্ষ্য, তাহলে বোধহয় কোন বাধাই বাধা নয়। আসুক যতই ঝড়, যত বিপদ, পথ যতই মোড়ানো থাকুক কাটায় আচ্ছন্ন।
হতে পারে এর বিপরীতেও বিভিন্নরকম অনেক গল্প আছে। কিন্তু ইতিবাচকভাবেই সব দেখতে চাই। এইতো ৯ ডিসেম্বর গেল বেগম রোকেয়ার জন্মদিন। তাঁকে স্মরণে রেখে বলতে চাই, আপনি ছিলেন বলেই আমরা নারীরা আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি। আপনিই যুগিয়েছিলেন সাহস। আপনি আমাদের অনুপ্রেরণা। অবগুন্ঠনের আড়াল হতে নিজেকে প্রস্ফুটিত করার চেতনা সেতো আপনার কাছ হতেই প্রাপ্ত।
এখন প্রতিদিন যখন সংবাদপত্র বা সোস্যাল মিডিয়া খুললেই নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা নেতিবাচক সংবাদ দেখি তখন কিন্তু আপনার মত আমারও মনে হয় আশাহত হবার কিছু নেই। মেঘের পিছনেই কিন্তু সূর্য উঁকি দিচ্ছে।