“৬ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া নিঝুম নিস্তব্ধ রাত। আমার এক বাড়ি ছড়ানো–ছিটানো লোক। সংখ্যায় চল্লিশের কাছাকাছি। এলোমেলোভাবে যে যেখানে পেরেছে মাদুর, কাঁথা, চাদর বিছিয়ে, নয়তো শূন্য মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। একদম চুপচাপ সবাই। এমনকি নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যায় না। গভীর অন্ধকারে কেবল পুরুষগুলোর মুখে জোনাকির মতো মিটমিট করে জ্বলছে সিগারেটের আগুন। জানিয়ে দিচ্ছে যে, তারা এখনো জেগে আছে। রাত কত হবে কে জানে! আকাশে আজ একটি তারাও নেই। শুক্লপক্ষের আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। আমার শোবার মেঝেতে বিক্ষিপ্ত শুয়ে আছি আমরা ক’জনা। মিনু আপা, জিনু কোলের বাচ্চাসহ রানু, আমার দুই মেয়ে আর আমি। আমাদের কাছে একটি খাটে শুয়েছেন ডা. শফী (আমার স্বামী) আমার ছোট মেয়েটিকে নিয়ে।” (স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন)। উপরোক্ত কথাগুলো বেগম মুশতারী শফীর লেখা। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধ সময়কার স্মৃতিকথার শুরুতেই লিখেছিলেন।
বেগম মুশতারী শফীর পরিচয় এক অভিধায় চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তিনি শহীদ–জায়া, শহীদ–ভগ্নি, নিজে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষে অংশগ্রহণকারী, সাংবাদিক, লেখক, সমাজ–সংস্কারক, সচেতন রাজনীতিবিদ সর্বোপরি প্রগতিচিন্তায় বিশ্বাসী আত্মপ্রত্যয়ী এক বিরলপ্রজ নারী। তাঁর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পিতার কর্মস্থল পশ্চিম বাংলায়। তবে, তাদের আদি নিবাস ফরিদপুর জেলা গেরদা গ্রামে। মাত্র ১৫ বছর বযসে তাঁর চেয়ে অপেক্ষাকৃত বয়সে বড় ডা. শফির সাথে তাঁর বিয়ে হলেও স্বামীর কর্মচাঞ্চল্য এবং স্ত্রীর প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে তিনি নিজেকে তৈরি করার অন্য এক জগৎ খুঁজে পেয়েছিলেন। লেখালেখিতে নিয়োজিত করলেন নিজেকে । বিশেষ করে সমকালীন সমাজে নারী প্রগতি ও নারী মুক্তির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বেতারে নিয়মিত কথিকা পাঠ, অনুষ্ঠান পরিচালনা থেকে শুরু করে দৈনিক পত্রিকায় লেখালেখি করেছিলেন। নারীদের সংগঠিত করার জন্য বান্ধবী সংঘ গঠন করে মাসিক ‘বান্ধবী’ পত্রিকা বের করেন। এই পত্রিকায় সব নারীরাই ছিল লেখক। প্রেস–এ কাজ করতেন নারীরা। প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে ছাপানো, বাঁধাই–এর কাজ নারীরাই করতেন। এসব কারণে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শুরু থেকেই রোষানলের শিকার হয়েছিলেন। এমন চরম মূল্য তাঁকে দিতে হলো তিনি স্বামীকে হারালেন, ভাইকে হারালেন। নিজে অত্যন্ত সাহস আর বুদ্ধিমত্তার জোরে বেঁচে গিয়েছিলেন। হানাদার বাহিনীর টার্গেট হওয়ায় তিনি বহু কষ্টে রক্ষা করেছিলেন সন্তানদেরকে। পায়ে হেঁটে ভারতের ত্রিপুরায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছিলেন। হায়েনারা তাঁর বাড়ি ঘর লুট করে, ‘বান্ধবী’ পত্রিকার অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এরপরেও তিনি দমে যান নি। গোপনে সাহায্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। আগরতলা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানান কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। দেশ স্বাধীন হলে সন্তান নিয়ে ফিরে এসে তিনি আরেক যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। স্বামী আর ভাইকে যুদ্ধে হারিয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে যান। বাড়ি–ঘরও লুটপাট হয়ে যায়। সন্তানেরা সবাই ছোট ছোট। কি অসীম সাহস আর ধৈর্য্য নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন! ‘বান্ধবী’ প্রকাশের চেষ্টা করলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সবকিছুই বিপর্যস্ত। নাজুক ব্যবসা–বাণিজ্য। অনেক কষ্টে আবার সংসারের হাল ধরলেন। সন্তানদের যোগ্যমানুষ হিসাবে গড়ে তোলার ব্রত গ্রহণ করলেন। নারী–মুক্তি, নারী–আন্দোলন ও সমাজসেবায় নিজেকে সমর্পণ করলেন। পাশাপাশি লেখালেখিতে থেমে ছিলেন না। । একের পর এক লিখে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম আর কষ্টের কাহিনীগুলোকে। বেশিরভাগ রচনা মহান মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েই। নারী উন্নয়ন এবং নারীমুক্তির বিষয়ই তাঁর লেখনিতে প্রাধান্য পেয়েছে বারেবারে। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হলো স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন, তুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী, মুক্তার মুক্তি, নারী বলো আমরাও মানুষ, বিপর্যস্ত জীবন, একুশের গল্প, একদিন এবং অনেকগুলো দিন, চিঠি জাহানারা ইমামকে, আমি সুদূরের পিয়াসী এবং অকালবোধন। প্রতিটি গ্রন্থেই তিনি তঁর জীবনঘনিষ্ঠ কাহিনী, জীবন সংগ্রামের চিত্রকেই সন্নিবেশিত করেছেন। তবে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ ঘুরেফিরেই নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি লেখায়।
আমার পরম সৌভাগ্য আমি এই মহিয়সী নারীর স্নেহধন্য ছিলাম। সাধারণ এবং বিনয়ী, ভেতরে সাহস আর তেজের উজ্জ্বল বহ্নিশিখার প্রতীক তিনি। আর এই বহ্নিশিখার মশাল হাতে নিয়ে তিনি চট্টগ্রামে যাবতীয় আন্দোলন সংগ্রামে পালন করেছেন অগ্রণী ভূমিকা। এই ত্যাগ ও সংগ্রামের জন্য অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছিলেন। বিভিন্ন দিবসে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য একাধিকবার আমি উনার বাসায় গিয়েছি। বাসায় খালি বই আর বই। অসংখ্য পদক–পুরস্কার কক্ষের দেয়াল জুড়ে। বেশ ক’বছর আগে দৈনিক পূর্বকোণ ও গ্রামীণফোনের পদক বিতরণ উপলক্ষে তাঁর জীবন সংগ্রামের উপর তথ্যচিত্র নির্মিতকালে আমি সারাদিন উনার বাসায় ছিলাম। দুপুরে একসাথে বসে ভাত খেলাম। সারাদিন গল্প শুনলাম। তাঁর জীবনের সংগ্রামের এবং সাহসের। সেদিন পূর্বকোণ এর শেষ–পাতায় তাঁর এই কাহিনী আমি লিখেছিলাম। নিজের লেখা প্রতিটি গ্রন্থ তিনি নিজেই লিখে আমাকে উপহার দিয়েছেন। এই ঋণ অপরিশোধ্য। আরেকবার তিনি ‘অনন্যা’ পুরস্কার নিচ্ছিলেন নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। আমি সেদিন উপস্থিত ছিলাম। নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি কেঁদেছিলেন অঝোরে। কাঁদিয়েছিলেন হলভর্তি দর্শকদেরও। উনাকে নিয়ে এতো স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব না। গত ২০ ডিসেম্বর ছিল তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী, এই দিনটিতে তাঁর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ।