বেকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা

ড. আনোয়ারা আলম | মঙ্গলবার , ২৫ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

জুলাই২৪ এর অভ্যুত্থানের পরে দেশের অর্থনীতিতে বড়ো ধরনের একটা ধস নেমেছে। বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কেউ দেশ ছেড়েছেনকেউ মামলায় অভিযুক্ত কেউ কারাগারে। অনেক ব্যাংক ব্যবস্থার টালমাটাল অবস্থার সাথে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিল্পকারখানা বিশেষত অনেক পোশাক শিল্প। কিন্তু পোশাক শিল্পই আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষ এবং দরিদ্র নারীসমাজ। একদিকে জনসংখ্যার আধিক্য অপরদিকে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সমস্যা বা বেকার সমস্যা। কোভিড১৯ পরবর্তী সময়ে বিশেষত উচ্চ শিক্ষিতদের অনেকেই কর্মচ্যুত হয়েছিলেন। কিন্তু অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল পোশাক শিল্প কারখানা। এখন সেখানেও একটা হাহাকার।

এর বিধ্বংসী প্রভাবের নেতিবাচক চিত্র নানাভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেকার সমস্যা যুগে যুগে ছিলো বিশেষত অনুন্নত দেশে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। অন্যতম কারণ জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতির সাথে দারিদ্র্যঅশিক্ষা এবং বিশেষত দুর্নীতির বিস্তার। আমরা দেখেছি কীভাবে দুর্নীতির রাহুগ্রাসে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

বেকার সমস্যার দুটি দিকব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষতি। ব্যক্তিগত ক্ষতির নেতিবাচক প্রভাবে বেড়েছে সামাজিক সমস্যা, মাদকাসক্তি, কিশোর গ্যাংগ, আত্মহত্যা ইত্যাদি। সামাজিক ক্ষতির দিকটি আরও মারাত্মক। লাখ লাখ লোক বেকার থাকলে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হয় তা অপূরণীয়।

অমর্ত্য সেনের চমৎকার একটি উপমা আছেধরা যাক একটি গ্রামের কথা। সেখানে যদি রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হয় তবে কিছু লোকের কর্মসংস্থান হয় এবং একইসাথে গ্রামের সাথে শহরের সংযোগ স্থাপনের ফলে ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে দেশের উন্নয়ন হয়। বেকার সমস্যা সমাধানে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো অনেকটা ব্যর্থ! সবচেয়ে বড়ো কারণ, পরিকল্পনার কাঠামোকে দেশের জনগণের প্রয়োজন ও আশাআকাঙ্ক্ষার দিকে লক্ষ্য রেখে করা হয়নি। দেশের চাহিদার তুলনায় একদিকে কাঠামো হয়েছে ক্ষুদ্র, অন্যদিকে ছিলো শুভঙ্করের ফাঁকি তথা অপচয় ও দুর্নীতি। এরসাথে যুক্ত হয়েছে কর ফাঁকির প্রবণতা। পরিকল্পনা ও দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো এবং সার্বিক দিক বিবেচনা করে করা হয়নি। বিশেষত কৃষি প্রধান দেশ হলেও সেটিকে মূলকেন্দ্রে রেখে সঠিক পরিকল্পনা করা হয়নি।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাতেও গলদ আছে। সবাই উচ্চ শিক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে যে কারণে শিক্ষিত বেকারত্বের হার বাড়ছে। এক্ষেত্রে দরকার কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে পুরো বিশ্বেই কর্মের দুয়ার খোলা। কিন্তু সেই সুযোগটা নিতে হলে তথ্যপ্রযুক্তিতে যথাযথ প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগটা করা দরকার যাতে দেশের তরুণ তরুণীরা এক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত হয়ে দেশে ও দেশের বাইরে কর্মের সুযোগ পেতে পারে।

অতি কঠিন সত্যি হলোদেশের অর্থনীতিতে বেকার সমস্যা এখন একটা অশনিসংকেতের মতো। এমনিতেই পুরো বিশ্ব এখন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে হিমশিম খাচ্ছে। যে কারণে বিশ্বে দেশের তরুণ তরুণীর জন্য কর্মের সুযোগ যেমন কমছে দেশের ক্ষেত্রেও তাই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের অর্থনীতি এক বড়ো ধরনের সংকটে।

আবারও বলতে হয় বিশ্বায়নের বড়ো সমস্যা হলো, বিশ্বায়ন পৃথিবী জুড়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। আর এটি খেটে খাওয়া মানুষের নিয়তি। অনিশ্চয়তা কি শুধু উন্নয়নশীল দেশের! তা নয় এটি শিল্পোন্নত দেশগুলোর শ্রমিকদেরও সমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সেসব দেশে দুভাবে কর্মসংস্থান কমছে। প্রথমত কারিগরি পরিবর্তনের ফলে কম শ্রমিক দিয়ে বেশি ও উন্নততর পণ্য এবং সেবা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। কাজেই চাকরির পরিমাণ কমছে। দ্বিতীয়ত, বৈদ্যুতিক যোগাযোগের ফলে অনেক সেবা অনুন্নত দেশগুলো থেকে কম মূল্যে সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে। বহিঃউৎস থেকে সংগ্রহের ফলে উন্নত দেশগুলোর অনেক চাকরি উন্নয়নশাীল দেশগুলোতে চলে যাচ্ছে। যে কারণে উন্নত দেশগুলোর শ্রমিকেরা অনিশ্চয়তায় ভুগছে।

পরিশেষে বলতে হয়১৮ কোটি জনসংখ্যার আমাদের এ দেশের অন্যতম সমস্যা বেকার সমস্যা। এটি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। কর কাঠামোর সংশোধন, উন্নয়নমূলক কাজের গতি বাড়ানো, গ্রাম অর্থনীতির যে অমেয় সম্ভাবনা আছে তা কাজে লাগানো, জনসংখ্যারোধে আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণ এবং শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবমুখী পরিবর্তনের মাধ্যমে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধউপযুক্ত পরিবেশ পেলে আমাদের মেধাবী তরুণরা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে
পরবর্তী নিবন্ধভারত থেকে এলো সাড়ে ১১ হাজার টন চাল