বৃহত্তর চট্টগ্রামে হঠাৎ করেই ম্যালেরিয়ার ভয়ানক থাবা। বিশেষ করে গত জুন মাস থেকে এ রোগের প্রকোপ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। কেবল জুন এক মাসেই এ অঞ্চলে ৫১৩৩ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে; যা এর আগের ৫ মাসে (জানুয়ারি-মে) শনাক্তের প্রায় ৩ গুণ। আগের ৫ মাসে এ অঞ্চলে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৯২১ জন রোগী শনাক্ত হয়।
এদিকে চলতি বছর সারা দেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের মাঝে এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে (২৪ জুলাই পর্যন্ত)। সবক’টি মৃত্যুই বৃহত্তর চট্টগ্রামের। চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় ও জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি (এনএমইপি) সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃহত্তর চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের ৮০ ভাগই পার্বত্য জেলা বান্দরবানের। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত গত ৬ মাসে এ অঞ্চলে মোট ৭ হাজার ৫৪ জন ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৬৮০ জনই বান্দরবানের। জেলাটিতে শুধু জুন মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৪ হাজার ১৫৭ জন। সব মিলিয়ে এ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ভয়ংকর হয়ে উঠেছে, যা অ্যালার্মিং হিসেবেই দেখছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
বিভাগীয় পর্যায়ে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু রোগ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ ও তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মফিজুল হক শাহ। তিনি আজাদীকে বলেন, জুন মাসে হঠাৎ ম্যালেরিয়ার প্রকোপটা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বান্দরবান, রাঙামাটি ও কক্সবাজার জেলায় এর প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে পার্বত্য বান্দরবান সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ জেলায় এক মাসেই (জুনে) চার হাজারের বেশি কেস (রোগী) পাওয়া গেছে, যা খুবই অ্যালার্মিং।
বান্দরবানে দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার ডা. শাহরিয়ার তানভির আহমেদও বলছেন, আগের বছরগুলোর তুলনায় জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার এবার অনেক বেশি। ম্যালেরিয়া নির্মূলে সব ধরনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এদিকে বান্দরবানের পর রাঙামাটি ও কঙবাজারে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এরপরই রয়েছে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম।
জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার হিসেবে চট্টগ্রাম ও কঙবাজারের দায়িত্বে রয়েছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম। জুন থেকে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ম্যালেরিয়ায় সারা দেশে এ পর্যন্ত ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর সবক’টি বৃহত্তর চট্টগ্রামের চার জেলার। এর মাঝে চট্টগ্রামের ৩ জন, কঙবাজারের ৫ জন, বান্দরবানের ২ জন ও রাঙামাটির ১ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ১১ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয় জানুয়ারিতে। জুন ও চলতি জুলাই মাসে বাকি ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৫ মাসে (জানুয়ারি-মে) চট্টগ্রাম জেলায় ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয় ১১ জন। আর কেবল জুন মাসেই শনাক্ত হয়েছে ৩৮ জন। কঙবাজার জেলায় আগের ৫ মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৪ জন। তবে জুন মাসে এ জেলায় রোগী শনাক্ত হয় ২৫৩ জন। রাঙামাটিতে আগের ৫ মাসে শনাক্ত হয় ২৭১ জন। আর কেবল জুন মাসেই আক্রান্ত হয় ৬২৯ জন। খাগড়াছড়িতে আগের ৫ মাসে রোগী পাওয়া যায় ৩২ জন। জুন মাসে এ সংখ্যা ৫৬ জন। বৃহত্তর চট্টগ্রামে কেবল এই জেলায় এখনো পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বেশি ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া গেছে বান্দরবান জেলায়। আগের ৫ মাসে এ জেলায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৫২৩ জন। কিন্তু জুন মাসেই শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ১৫৭ জন, যা আগের ৫ মাসের শনাক্তের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ বেশি। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বান্দরবানই এ মুহূর্তে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
ম্যালেরিয়ার প্রকোপের এ পরিস্থিতিকে ‘ভয়ংকর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী। জেলায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত ২ জনের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলে আমাদের যাবতীয় কর্মসূচি চলমান আছে। এরপরও এ রোগের প্রকোপ বর্তমানে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে লামা, আলীকদম ও থানছি উপজেলায় এর প্রকোপ বেশি। এটি অ্যালার্মিং বলা যায়। আক্রান্ত কেউ যাতে মারা না যায় সেটাই এখন লক্ষ্য জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা সেভাবেই কাজ করছি। মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। সেভিয়ার ম্যালেরিয়ায় একবার অচেতন হয়ে পড়লে ওই রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পরিবারে কারও জ্বর হলে দেরি না করে যাতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসে। দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে। কারণ, প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হলে ওই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। তবে বেশ কিছু উপজেলায় দুর্গম ও গহীন অঞ্চল রয়েছে; যেখানকার মানুষ সচেতন নয়। এসব অঞ্চলে মানুষের অসচেতনতাও একটি বড় সমস্যা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বান্দরবানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৭০৯ জন। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয় ৪ হাজার ১৬৬ জন। ২০২১ সালে রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২২৮ জন। হিসেবে চলতি বছরের আরো প্রায় ৬ মাস বাকি থাকলেও শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। চলতি বছরের ৬ মাসেই এ জেলায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৮০ জনে। এদিকে চলতি বছরে ২ জন ছাড়াও ২০২০ ও ২০২১ সালেও দুজন করে রোগীর মৃত্যু হয়েছে এ জেলায়। যদিও এটি সরকারি হিসাব। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে দাবী স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের।
ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মফিজুল হক শাহ বলছেন, করোনার কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধমূলক বেশ কিছু কর্মসূচি স্বাভাবিকভাবে করা যায়নি। এর মাঝে রুটিন স্প্রে করার যে কর্মসূচি সেটি করা সম্ভব হয়নি। প্রতি বছর জুন মাসের দিকে এই স্প্রে করা হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে গত দুই বছর সেটি করা যায়নি। তাছাড়া মশার সার্ভে কর্মসূচিও ঠিকভাবে করা যায়নি। সব মিলিয়ে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেড়েছে বলে আমরা মনে করছি।
পার্বত্য অঞ্চলে সারা বছর রোগী পাওয়া গেলেও জুন-জুলাই মাসে এ রোগের প্রকোপ খুব বেশি। এ রোগ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে কীটনাশকযুক্ত মশারি ব্যবহার, সব সন্দেহজনক জ্বরের রোগীর মানসম্মতভাবে ম্যালেরিয়া শনাক্ত বা নিশ্চিত করে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান, রোগ ও কীটতাত্ত্বিক নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ।
এসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নির্মূলকরণে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যার মধ্যে দুর্গম এলাকায় দক্ষ চিকিৎসক স্বল্পতা ও সহজে চিকিৎসা দিতে না পারা, নগরায়ণ ও সময়ের পরিবর্তিত বাস্তবতায় মানুষের দ্রুত অবস্থানগত পরিবর্তন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন অন্যতম। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশকযুক্ত মশারি প্রতিদিন সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টানানো, তিন বছর পর পর সাধারণ মশারি কীটনাশকে চুবিয়ে ব্যবহার করা, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, ডোবা, নর্দমা, পুকুর, গর্ত পরিষ্কার রাখাসহ অ্যানোফিলিস মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকার কথা বলেছেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা।