বৃহত্তর চট্টগ্রামের কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র রাঙ্গুনিয়ায়, সেবা দিচ্ছে ১১২ বছর ধরে

বিদেশি অনুদান বন্ধ থাকায় চলছে ধুকে ধুকে

জগলুল হুদা, রাঙ্গুনিয়া | রবিবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাইয়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত ১১২ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী খ্রীষ্টিয়ান কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র চন্দ্রঘোনা। এটি ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন কুষ্ঠ হাসপাতাল এবং বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগের একমাত্র কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্র। একসময় বিদেশি অনুদানে পরিচালিত হতো এই কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্রটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারিভাবে দেশে কুষ্ঠ রোগী একেবারে কমে আসার ঘোষণায় সেই অনুদান একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এরপরও খ্রীষ্টিয়ান হাসপাতাল চন্দ্রঘোনার অর্থায়নে এটি এখনো বৃহত্তর চট্টগ্রামের জটিল ও প্রতিবন্ধী কুষ্ঠরোগীদের একমাত্র রেফারেল হাসপাতাল। রোগনির্ণয়, চিকিৎসা, খাবার ও প্রতিবন্ধী রোগীদের নানা উপকরণ এখানে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। কুষ্ঠ চিকিৎসা ছাড়াও কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এটি অব্যাহতভাবে পরিচালনায় বিভিন্ন এনজিও সংস্থার পাশাপাশি সমাজের ধর্নাঢ্য শ্রেণির মানুষের সহায়তা চেয়েছেন কতৃপক্ষ।

হাসপাতাল সুত্রে জানা যায়, ৬০ শয্যা বিশিষ্ট খ্রীষ্টিয়ান কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্রটি ১৯১৩ সালে স্থাপিত হয়। ইংল্যান্ড ভিত্তিক দ্যা লেপ্রসী মিশন এর অর্থায়নে এ কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিচালিত হতো। কিন্ত ১৯৯৪ সালের পর হতে অর্থায়ন কমিয়ে দেয় এবং ২০১০ সালের পর হতে তাদের অর্থায়ন একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হতে কোনো রকম সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য ছাড়া চলছে এ শর্তবর্ষী হাসপাতালটি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯২০ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মাঝে কুষ্ঠ রোগ ব্যাপকভাবে দেখা দেয়ায় তখন ইংল্যান্ডের আর্থিক সহযোগিতায় হাসপতালটি বৃহৎ পরিসরে আলোর মুখ দেখে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার লোক এ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য আসতো। কুষ্ঠ রোগীদের সমাজে জায়গা না হওয়ায় সব কুষ্ঠ রোগীদের এক সাথে বসবাসের জন্য চন্দ্রঘোনাকদমতলী ইউনিয়নের ঝুম পাড়া কুষ্ঠ পল্লীতে তাদের আবাসস্থল করা হয়েছে। বর্তমানে কুষ্ঠ রোগীরা আর্থিক সঙ্কটের কারণে চরম মানবেতর ও হাসপাতাল বন্ধের পথে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালে ১৯ জন কুষ্ঠ রোগী রয়েছে। এরমধ্যে ৭ জন নারী ১২ জন পুরুষ। কেন্দ্রের অধিকাংশ শয্যা শূন্য। কেন্দ্রের সঙ্গে একটি ছোট জুতার কারখানা আছে। কিছু প্রতিবন্ধী রোগীর জন্য বিশেষ উপাদানের ও বিশেষ ধরনের জুতা এখানেই তৈরি হয়। বাইরের কুষ্ঠরোগী এবং অন্য কুষ্ঠ প্রতিষ্ঠানও এখান থেকে জুতা তৈরি করে নেয়। রোগীদের ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থাও আছে।

হাসপাতালে থাকা রোগীরা জানান, কেউ দীর্ঘ বছর ধরে কেউবা আবার সমপ্রতি এসেছেন এই হাসপাতালে। রোগীদের মধ্যে তিন পার্বত্য এলাকার রোগী যেমন আসে, তেমনি আসেন সারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। সকলে কুষ্ঠ বলে তাদের কেউ ছুয়ে দেখে না, সমাজ তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। তাদের কেউ কেউ হাসপাতাল থেকে ৩৫৪০ বছর ধরে চিকিৎসা সেবা নিয়ে রোগ পুরোপুরি ভালো হয়েছেন। কেউ ভালো হয়ে, কুষ্ঠ চিকিৎসা কেন্দ্রটিতেই চাকরি করেছেন। কেউবা সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে হাসপাতালের কুষ্ঠ পল্লীতেই নিজেদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। এভাবেই চলছে তাদের জীবন।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং বলেন, কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসায় হাসপাতালটি শুরু থেকেই পুরোপুরি বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে বিদেশি অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। যে কারণে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কুষ্ঠ রোগীদের ওষুধ, চিকিৎসা ও খাবারসহ অন্যান্য বিষয়টি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হয়। ফলে আমাদের জেনারেল হাসপাতালের ওপর চাপ পড়ে যায়। বছরে কুষ্ঠ হাসপাতালের জন্য ৫০৬০ লাখ টাকা খরচ করতে হয় জেনারেল হাসপাতালের ফান্ড থেকে। তাই এই হাসপাতাল চালিয়ে নিতে আমরা ভিত্তবান ও এনজিও সংস্থার সহায়তা কামনা করছি।

তিনি আরও বলেন, এখনো নিয়মিত রোগীর চাপ রয়েছে হাসপাতালে। গুরুত্ব বিবেচনায় তাদের ভর্তি নেয়া হয়। যাদের নিয়মিত ড্রেসিং করতে হয় কিংবা ভর্তি না নিলেই নয়, তাদেরকেই রাখা হয়। অন্যথায় আউটডোরে চিকিৎসা আর ঔষধ দিয়েই পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ হাসপাতালে রাখলেই তাদের বিনামূল্যে সব কিছু করতে হয়। কিন্তু হাসপাতালের সেই সামর্থ এখন আর নেই। তাই এটি টিকিয়ে রাখতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। অন্যথায় রোগীদের ঢাকা কিংবা দূরের কোন জেলায় গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো জীবনে সফলতা আসবে
পরবর্তী নিবন্ধডা. সুলাল কান্তি শীল