ছয় ঋতুর দেশে এসেছে আষাঢ়, ফুটেছে কদমফুল। শুধু কদম নয়, ফুটেছে কেয়া, বকুল, যুথী, জুঁই, কেতকী, কামিনী, মালতী, চন্দ্রপ্রভা, ঝুমকোলতা, দোলচাঁপা, মোরগঝুঁটি, হলুদ কসমস, দোপাটি, সন্ধ্যামণি, টিথোনিয়া, টোরেনিয়া, বেলি, গন্ধরাজসহ আরো কতো ফুল। বাংলাদেশে বরষায় সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে। ফুলের সৌন্দর্য দেখে চমকিত হতে হয়। বরষা এলে চোখে পড়ে ফুলের সমারোহ। ফুলের সৌরভে বিমোহিত হয়েছেন কবিরা। বাংলাসাহিত্যে বরষা নিয়ে গান–কবিতা লেখেননি, এমন কবি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/নদে এল বান।’ এমন ছড়া বা কবিতার মাধ্যমে শিশুদের কাছে বরষার আগমনী বার্তা পৌঁছে যায়। ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’ বা ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ এর মত জনপ্রিয় গানগুলিও বরষার রূপ–যৌবন শিশুদের কাছে তুলে ধরে।
ঋতুচক্রের হিসেবে আষাঢ়–শ্রাবণ দুই মাস বরষাকাল। কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর আগমন ও বিদায়ে এখন হেরফের হয়ে থাকে। ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে/ কুঞ্জপথে সখি, ক্যায়ছে যাওব অবলা কামনিী রে’ –রবীন্দ্রনাথের গান এটি। আবার নজরুল লিখেছেন -‘শাওন–রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে/ভুলিও স্মৃতি মম, নিশীথ–স্বপন সম/আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিও পথ পরে/ ঝুরিবে পূবালি বায় গহন দূর–বনে/ রহিবে চাহি তুমি একলা বাতায়নে।’ এ সময় আকাশে সারাক্ষণ চলে ঘনকালো মেঘের আনাগোনা। ‘মেঘের পর মেঘ জমেছে আধার করে আসে/ আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।’
বরষায় গ্রাম বাংলার নদী–নালা, খাল–বিল, পুকুর–ডোবা, নিম্ন–ভূমি সবকিছু পানিতে তলিয়ে যায় বলে নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। গ্রামের মানুষকে এ সময় নৌকা, ডিঙি প্রভৃতিতে চড়ে চলাফেরা করতে হয়। চণ্ডীদাস লিখেছেন -‘এ ঘোর রজনী, মেঘের ঘটা, কেমনে আইল বাটে/আঙিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে, দেখিয়া পরাণ ফাটে।’
বাঙালির জীবনমান কৃষি নির্ভর, বরষা কৃষিক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। কবি–সাহিত্যিকদের সৃষ্টিশীলতায় বরষা যেন পূর্ণতা পেয়েছে। বরষার নতুন জল পেয়ে বৃক্ষরাশি জেগে উঠে নতুন করে। যেন তারা এতদিন ধরে আকাশের কাছে প্রার্থনায় ছিল। কখন বৃষ্টি নেমে তাদের প্রাণ ফেরাবে। নদী তার যৌবন ফিরে পায় এই সময়। শুধু নদী কেন বরষার অপেক্ষায় তাকে আরো কত সৃষ্টি। ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ কিংবা ‘গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।’ রবীন্দ্রনাথের আষাঢ় কবিতায়, নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, আউশের ক্ষেত জলে ভরভর, কালি মাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিছে দেখ চাহি রে। ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে/পাগল আমার মন জেগে উঠে। এখানেই শেষ নয় রবীন্দ্ররচনায় বরষার উপস্থিতি।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বরষাকে দেখেছেন গভীর অনুভূতি দিয়ে। তাঁর ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় তা অনুধাবন করা যায় -‘ওগো বাদলের পরী/ যাবে কোন দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী।/ ওগো ও ক্ষণিকা, পুব–অভিসার ফুরাল কি আজি তব?/ পহিল ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব? অনেক গানে তিনি বর্ষা ও বৃষ্টির অবিরল জলধারায় প্রকৃতির অপরূপ বৈভব তুলে ধরেছেন। ‘ঝিলের জলে কে ভাসাল নীল শালুকের ভেলা।/ মেঘলা সকাল বেলা।/বেণু বনে কে খেলে রে পাতা ঝরার খেলা/ কাজলা বরণ পল্লী মেয়ে, বৃষ্টিধারায় বেড়ায় নেয়ে।’ বরষা মেঘলা আকাশ, জলে ডুবে যাওয়া পথ, প্রেমিক মনে কারণ–অকারণে নানা কথা, স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। কখনও তা আনন্দ অনুভবে কখনও বিষাদে বিরহে। নজরুল ইসলামের অসংখ্য গানে সেই সুর ধ্বনিত হয়। এ রকম একটি গান– ‘থৈ থৈ জলে ডুবে গেছে পথ/এস এস পথ–ভোলা/ সবাই দুয়ার বন্ধ করেছে।’
শামসুর রাহমানের কবিতায় বৃষ্টি ও বরষা এসেছে এক ভিন্নতর অবয়বে। চলে যাওয়ার মুহূর্তে বৃষ্টি যেন নিজ রূপে না আসে, যেন কাদায় না ভেজে শহর সে মানবিক আর্তি ব্যক্ত করেছেন তিনি। তাঁর বিবেচনা (নিজ বাসভূমে) কবিতায় এরকমভাবে– সেদিনও কি এমনি অক্লান্ত ঝরঝর বৃষ্টি হবে এ শহরে?/ ঘিনঘিনে কাদা/ জমবে গলির মোড়ে সেদিনও কি এমনি,/ যেদিন থাকবো পড়ে খাটে নিশ্চেতন,/ নিবির্কার মৃত?
আর নন্দিত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় ঋতু বরষা। তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতায় বরষাকে এনেছেন, সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এই বরষায়’ মানবহৃদয়ের হাহাকার ও আকুলতা অনবদ্যভাবে তুলে ধরে। বাংলা কবিতা ও গানে বরষা তার রূপ, মাধুর্য, সৌন্দর্য স্বরূপে বর্ণিত হয়েছে নানাভাবে।