মেঘেদের সীমানা পেরিয়ে আকাশের এককোণে থাকে বৃষ্টিবুড়ি। বৃষ্টিবুড়ির মনে অনেক কষ্ট। সেই কষ্টের কথার শব্দ শোনা যায় মেঘেদের গুড়ুম–গুড়ুম স্বরে। যখন অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে তখন ঝরঝরিয়ে বৃষ্টিধারা হয়ে ঝরতে থাকে। জলের ধারা যখন উত্থাল–পাতাল ঢেউ জাগিয়ে যায়, স্রোতে ভেসে যায় ধানের ক্ষেত, সবজির ক্ষেত। ডুবে যায় নীচু এলাকার ঘরবাড়ি। তখন প্রকৃতি হয়ে উঠে বিরূপ। মানুষের দুঃখে বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এমন খবর নিয়ে আকাশে উড়ে যায় কুটুমপাখি। কুটুমপাখি বৃষ্টিবুড়ির কাছের বন্ধু। দুজনের মধ্যে বেশ ভাব।
কুটুমপাখি পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে বেড়ে ওঠা বটগাছের শাখায় থাকে। আদাড়ে–বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে সময় কাটিয়ে সে বেশ আনন্দবোধ করে। তার সারাশরীরে হলুদ নীলের সমাহার লম্বা পালক। দুটি চোখ ছলছলে মুক্তোদানার মতো। সে যখন সুর করে ভাবের প্রকাশ করে তখন পথচারীর মন জুড়িয়ে যায়। কাঠুরিয়ারা যখন বনের কাঠ কাটতে আসে। কুটুমপাখির এমন সুর শুনে তারা থমকে যায়। বনের গাছ কাটার কথা ভুলে তারা সুরের মায়ায় হারিয়ে যায়। আবার রাতের গভীরে সবাই যখন ঘুমঘোর চোখে ভাবনায় ডুব দেয়। তখন এই পাখি ঘুরে–ঘুরে উড়ে–উড়ে সুর বিলিয়ে যায়, লোকে ভাবে–আহা! কী মধুর সেই সুর।
কুটুমপাখির এমন মনকাড়া সুরে মুগ্ধ হয় বৃষ্টিবুড়ি নিজেও! বৃষ্টিবুড়ি আর কুটুমপাখি দুজন দুজনার মুখোমুখি হলে সব ব্যথা ভুলে যায়। এমনকি হাসতে ভুলে যাওয়া বৃষ্টিবুড়ি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। সেই হাসির ঝর্ণাধারা সূর্য্য মামার মন ছুঁয়ে যায়। তখন বৃষ্টিঝরা ক্ষেতে রোদের হাসি জেগে ওঠে। উত্তাল পাতাল ঢেউ জাগানো নদী স্বস্তি ফিরে পায়। কাঁদামাখা পথঘাট আবার চলার উপযোগী হয়ে ওঠে।
একদিন কুটুমপাখি বৃষ্টিবুড়িকে বললো-“তোমার কিসের এতো দুঃখ? কেনোইবা তুমি অমন করে কাঁদো”?
জবাবে বুড়ি বললো–পৃথিবীতে আমার অনেক আপনজন আছে। যারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পায় না। অনেকে আছে কেবল অসৎ আনন্দে মেতে ওঠে। অথচ সবার সমানভাবে বাঁচার অধিকার আছে। অথচ… বলতে–বলতে বৃষ্টিবুড়ির দুচোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠে। অমনি মেঘেদের কালিমাখা রঙ জমাট বেঁধে কালবৈশাখী ঝড়ে পরিণত হয়।
“কুটুমপাখি” দুহাতে তার অশ্রু মুছিয়ে দেয়। তাকে একটু হাসানোর চেষ্টা করে। ধীরে মেঘেদের অভিমানও টুটে যায়। আকাশটা ফর্সা হয়ে উঠে। কুটুমপাখি বললো–তোমার একটুখানি কান্নায় আকাশে মেঘেদের মন ভারী হয়ে ওঠে। আর অবারিত জলরাশিতে ঢলের সৃষ্টি হয়। এতে তোমার আপনজনেরা তো ভীষণ কষ্ট পায়। তা কী তুমি জানো না…।
বৃষ্টিবুড়ি বললো–জানি, আমি কী আর সখ করে কাঁদি! (একটু ভেবে)… কখনো আনন্দেও কাঁদি। যখন আমার দুখী আপনজনেরা অন্যদের স্নেহে সিক্ত হয়। যখন তারা নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর হয়। তখন আমার অশ্রুরাশি খড়ার বুকে সুখের রাশি ছড়িয়ে যায়। ক্ষেতের বুকে নতুন ফসলের প্রাণ জাগে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে এমন প্রাণের বান জাগে।
কুটুমপাখি ভালোবাসে ফুল–পাখি–প্রকৃতি। বৃষ্টিবুড়ি ভালোবাসে তার আপনজনেদের। একদিন দুজনে মিলে ঠিক করলো–পৃথিবীতে সুখের ঝর্ণাধারা রচনা করবে। একদিন দুজনে মিলে ঠিক করলো–পৃথিবীতে সুখের ঝর্ণাধারা রচনা করবে। বৃষ্টিবুড়ি কোথাও কারো দুঃখ দেখলেই অকারণ কান্না জুড়ে দেয়। এতেই ঘটে যায় নানা অঘটন। কুটুমপাখি তার সুরে–সুরে ভোলাতে জানে মানুষের অন্যায় মনোভাব।
একদিন দুজন মিলে ঠিক করলো। চারিদিকে আনন্দে ভরিয়ে দেবে। অকারণ দুঃখ ঘুচিয়ে দেবে। সব ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেবে। তাই কুটুমপাখি সুর ছড়িয়ে প্রাণ ভরিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বৃষ্টিবুড়ি মেঘে ভেসে তার প্রিয়জনের খবর রাখে। কখনো কারো বেদনায় ব্যথিত হয়ে উঠে। এ সময় কুটুমপাখি সুর করে তার মন ভরায়। আবার দুজন ছুটতে থাকে, দূরে…বহু দূরে।