বর্ষা আবার এসেছে। অনেক কাটখড় পুড়িয়ে এসেছে। এই ঝুম বৃষ্টিতে মনে আনে প্রশান্তি, উদাস হয় মন। নগর জীবনে বর্ষা কিছুটা ভোগান্তির। উত্তপ্ত শহর আস্তে আস্তে শীতল হয়ে ওঠে। শহরের যান্ত্রিকতায় গ্রামের মতো বর্ষাকাল উপভোগ করা না গেলেও বর্ষাকাল ঠিকই সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির হয়েছে। উঁচু কংক্রিটের ফাঁকে ফাঁকে ঘন কালো মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি খেলা অসাধারণ মনে হয়। এ সময় শহরের খাল ও লেক পানিতে ভরে যায়।
বর্ষায় সৌন্দর্য–রূপ বৈচিত্র্য কবি–সাহিত্যিকদের মুগ্ধ করে। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ বর্ষাকে ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন বৃষ্টিকে। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়/ যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো চলে এসো এক বরষায়/ ঝরঝর বৃষ্টিতে জলভরা দৃষ্টিতে/ এসো কোমল শ্যামলও ছায়ায়।’ বৃষ্টিবিলাসী ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। গানটি বেরিয়ে এসেছে এই জনপ্রিয় ও কথাসাহিত্যিক চলচ্চিত্রকারের কলম থেকে। বৃষ্টি তাকে কতটা আলোড়িত করেছে তার প্রমাণ মেলে গল্প ও উপন্যাসে। তার পরিচালিত বিভিন্ন ছবিতেও তিনি ক্যামেরাবন্দি করেছেন বৃষ্টিকে। বৃষ্টি আর জোছনাকে নিয়ে তিনি নিত্য খেলা করেছেন।
‘আগুনের পরশমণি’ হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিখ্যাত চলচ্চিত্র। চারদিক বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়ায় গাছের ডালপালা উত্তাল। এমন আকাশেও একটি হেলিকপ্টার উড়ছে। শুকনো পিচঢালা পথে অল্প অল্প ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। এরপর স্থির পানিতে অঝোরে বৃষ্টি পড়তে থাকে। বৃষ্টিজুড়ে যায় আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের ‘এসো নীপবনে’ গানের সুর বাজতে থাকে।
‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’র ছবিতে বৃষ্টি নেমে যায়। দুই দুয়ারী ছবিতে গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির পানি পড়ছে। অন্ধকার রাতে অল্প বাতির আলো। ‘বরষার প্রথম দিনে ঘন কালো মেঘ দেখে/ আনন্দে যদি কাঁপে তোমার হৃদয়/ সেদিন তাহার সাথে করো পরিচয়/ কাছে কাছে থেকেও যে কভু কাছে নয়’। ‘দুই দুয়ারী’ ছবিতে নায়ক–নায়িকাদের বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা যায়। ‘চন্দ্রকথা’, ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ছবিতেও তিনি বৃষ্টিপ্রীতি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। এবার তিনি নিজে গান না লিখে দ্বারস্থ হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। ‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে’ গানটি। এক পর্যায়ে বেজে ওঠে ‘আমার আছে জল’ গানটি। ‘বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান’ এর সঙ্গে ছবির প্রধান চরিত্রের সাথে মনের একান্ত গোপন ভাব ফুটে ওঠে। ঘেটু পুত্র কমলা মেঘমালা ছুটে যাচ্ছে। আকস্মিক বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। তারপর পদ্মপাতার ওপর ঝুম বৃষ্টি পড়তে থাকে। আবহে বেজে উঠে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের করুণ সুর।
হুমায়ূন সাহিত্যকর্মে হিমু অদ্ভূত চরিত্রের নাম। সে কখনো রহস্যময়ী, কল্পনা তার নিত্যসঙ্গী, বৃষ্টি খুব ভালো লাগে। মাঝে–মধ্যে মাথা ন্যাড়া করে, দিনে কখনো রাতে বেলায় উদাসী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। হিমু মূলত একজন বেকার যুবক যার আচরণ অনেকটা অস্বাভাবিক। চাকরির সুযোগ থাকলেও সে চাকরি কখনো করে না বলেই সে বেকার। সে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে। আবার মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। হিমুকে পাওয়া যায়–ময়ূরাক্ষী, দরজার ওপাশে, হিমু, পারাপার, এবং হিমু…,হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্মসহ আরো অনেক সৃষ্টিকর্মে। তাঁর আরেকটি ব্যতিক্রমী চরিত্র মিসির আলী শুভ্র। মিসির আলীকে নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে–দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন, নিষাদ, বৃহন্নলা, ভয়, বিপদ, অনীশ, মিসির আলীর অমিমাংসিত রহস্য, তন্দ্রাবিলাস, আমিই মিসির আলী, বাঘবন্দী মিসির আলী, হরতন ইশকাপন, মিসির আলীর চশমা, কহেন কবি কালিদাস, মিসির আলী! আপনি কোথায়? মিসির আলী আনসলভ, যখন নামিবে আঁধার। শুভ্র নিয়ে উপন্যাস হচ্ছে–দারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, এই শুভ্র! এই, শুভ্র গেছে বনে।
হিমু চরিত্রের স্রষ্টা নাটক, সিনেমা, গান, শিশুতোষ বলতে গেলে যেখানে বিচরণ করেছেন, সেখানে স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন। বইবিমুখ পাঠককে তিনি বইমুখী করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
একজন সন্ত্রাসীকে তিনি মানবিকভাবে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যাকে কমবেশি সবাই ভালোবেসেছেন। বিটিভিতে প্রচারিত ধারাবাহিত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’ তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। বাকের ভাইকে ফাঁসি দেয়া চলবে না, কিংবা বাকের ভাইয়ের কিছু হলে সারা বাংলা আগুন জ্বলবে – এ ধরনের কতো স্লোগান উঠেছিল ঔ সময়ে।
শিশুদের জন্য তাঁর ভালোবাসা প্রগাঢ়। ‘নীল হাতী’, ‘রূপকথা’, ‘পুতুল’, ‘বোতল ভূত’, ‘নুহাশ এবং আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ’, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘সূর্যের দিন’ এবং রহস্য উপন্যাস ‘অন্যভুবন’ অন্যতম।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলাসাহিত্যের অসাধারণ প্রতিভা। যিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, পরিচালক। এমন প্রতিভা সবসময় দেখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহকে তিনি অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছেন সৃষ্টিশীলতায়। বৃষ্টিকে তিনি এতোটাই ভালোবাসতেন বিদায় নিতে চেয়েছিলেন বর্ষণমুখর দিনে। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাদল দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে যান। প্রিয় নুহাশপল্লীতে তিনি চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছেন।