বৃক্ষমেলা আর বিদ্যুতের খেলা

মোঃ শফিকুল আলম খান | মঙ্গলবার , ৯ আগস্ট, ২০২২ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

বন বিভাগ ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গত চার আগস্ট থেকে সিআরবির শিরীষতলায় শুরু হয়েছে বৃক্ষ মেলা। চারদিকে পাহাড়, গাছ গাছালীতে ভর্তি প্রকৃতির আধার বলে খ্যাত সিআরবির শিরীষ তলায় মেলার এই আয়োজন, প্রকৃতি প্রেমিকদের মনে নিঃসন্দেহে বাড়তি পাওনা হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রকৃতির নির্মল পরিবেশে তারা তাদের পছন্দের গাছগুলো কিনে মনের আনন্দে নিজ নিজ নীড়ে ফিরতে পারবে। এ কারণে আয়োজকদের অবশ্যই সাধুবাদ দেয়া যায়। তবে খুবই দুঃখজনক হলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের এই ক্রান্তিলগ্নে যখন সরকারিভাবে বিদ্যুতের কৃচ্ছতা সাধন চলছে ঠিক এই সময় মেলায় চলছে বিদ্যুৎ অপচয়ের মহোৎসব। চারদিকে রঙিন বাতির আলোর মিছিল ছাড়াও প্রতিটি দোকানে লাগানো হয়েছে খুবই শক্তিশালী বাল্ব। চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা রাতের পরিবেশকে মোহণীয় করে তুললেও সুন্দর সকালে এই আলোর খেলা যেন সমস্ত পরিবেশকে ভেঙচি কাটছে।
৬ আগস্ট শনিবার প্রাতঃ ভ্রমণে বের হয়ে সিআরবির শিরীষতলায় সরকারিভাবে বিদ্যুতের এই অপচয় দেখে একটু থমকে দাঁড়ালাম। কৌতুহলবশত মেলার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। তখন ভোর পৌনে সাতটা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। মেলার প্রবেশ পথে এবং মঞ্চের সামনে কয়েকজন প্রহরী বা দোকানের কর্মচারী চেয়ারে বসে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আর মেলার ভেতরে বাইরে চলছে বিদ্যুতের ঝলকানি। ভাবছি, মেলাতে হয়তো রাত দশটা অবধি বৃক্ষ প্রেমিকদের বিচরণ ছিল যদিওবা সরকারিভাবে আটটার পরে কোনো দোকানপাট খোলা থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকারিভাবে আয়োজিত এই মেলায় যদি সকাল অবধি অপ্রয়োজনে এভাবে বিদ্যুতের অপচয় হয় তাহলে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সরকারি উদ্যোগ কিভাবে সফল হবে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বিশ সালের মার্চ থেকে দু বছর ধরে করোনা মহামারী সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। করোনার লাগাম টেনে বিশ্বের দেশগুলো যখন ধীরে ধীরে একটু ঘুরে দাড়ানোর প্রয়াস শুরু করেছে ঠিক সেই মুহুর্তে ইউক্রেন রাশিয়ার অনাকাঙ্ক্ষি যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। বলা যায় দু’বছরে করোনায় বিশ্বের অর্থনীতিকে যতটুকু ক্ষতি করতে পারে নি রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ তার চেয়ে শতভাগ বেশি বিপর্যস্ত করেছে। পৃথিবীর খুবই উন্নত, উন্নয়নশীল বা অনুন্নত এমন কোনো দেশ নেই যেখানে এই যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব পড়েনি। পৃথিবীর বড় ছোট সব দেশ বর্তমানে তীব্র জ্বালানি সংকটে ভুগছে। সংকট সৃষ্টি হয়েছে ভোগ্য পণ্যে। দেশে দেশে হ্রাস পাচ্ছে টাকার বিনিময় হার। সব দেশে জিনিস পত্রের দাম হচ্ছে আকাশচুম্বি। হ্রাস পাচ্ছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা। এই সমস্যা কোনো দেশের কোনো একক সমস্যা নয়। পৃথিবীর সর্বত্র বিরাজ করছে একই অবস্থা। তাই উন্নত অনুন্নত সব দেশেই জ্বালানীসহ বিভিন্ন বিষয়ে কৃচ্ছতা অবলম্বনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে বাংলাদেশ সরকারও বিদ্যুতসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে ব্যয় সংকোচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আর এটা হচ্ছে সম্পূর্ণ সাময়িক পদক্ষেপ।
কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুতের কোনো ঘাটতি নেই। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২৫৫১৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছিল। আর ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল পযর্ন্ত সর্বোচ্চ ১৪৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকার দেশে শতভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করেছিল। এই সরকারের অনেকগুলো ঈর্ষণীয় সাফল্যের মধ্যে দেশে শতভাগ সার্বক্ষণিক নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা ছিল অন্যতম। বতর্মান প্রজম্মের সন্তানেরা এক মাস আগেও লোডশেডিং কি জানত না বা বুঝত না। আর অতীতের অন্যান্য সরকারের আমলে যারা লোডশেডিং এর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়েছিল তারাও লোডশেডিং কি ভুলে গিয়েছিল।
১৯০০ থেকে ৮৪ সাল পযর্ন্ত ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি লাইফে সিনিয়র সাব এডিটর হিসেবে কাজ করেছি। প্রতিদিন বিকেল পাচঁটায় নিউজ ডেস্কে পৌছে দেখতাম বিদ্যুৎ নেই। অপেক্ষার পর অপেক্ষায় থাকতে হত। মোমবাতি একটার পর একটা ক্ষয় হয়। পিয়ন কুদ্দুস এসে কিছুক্ষণ পর পর নতুন মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়। এদিকে বাসা থেকে কিছুক্ষণ পর পর নির্বাহী সম্পাদক নুর সাইদ চৌধুরী বিদ্যুৎ প্রকৌশলীদের ফোন করার জন্য তাগিদ দিতে থাকে। আমরা হয় নির্বাহী প্রকৌশলী না হয় প্রধান প্রকৌশলীকে অনবরত ফোন করতে থাকি। কিন্ত কে কার কথা শোনে। বিদ্যুৎ কখনো পাওয়া গেলে তা ছিল ক্ষণস্থায়ী।
৮৯ সাল থেকে লালখান বাজারে পাহাড়ের উপর রেলওয়ে বাংলোতে বহু বছর ছিলাম। লোডশেডিংয়ে সমস্ত এলাকা তখন রাতে অন্ধকারের নিমজ্জিত হয়ে থাকতো। রেলওয়ের বিশাল বিশাল বাংলোর ছাউনিগুলো ছিল টিনের। টিনের গরমে বাসায় থাকা যেত না। তখন বাংলোর সামনের বাগানে পাটি বিছিয়ে গভীর রাত অবধি ঘুমাতাম অথবা চেয়ার নিয়ে আমরা স্বামী স্ত্রী বসে থাকতাম। এককথায় সে সময়ে কতঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকতো সেটাই ছিল মুখ্য। ১৯৯৫ সালে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ২৮১৮ মেগাওয়াট যা সে সময়ের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশও নয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে জরুরিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কুইক রেন্টাল সিস্টেম সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যার ফলে দেশে বিদ্যুৎ সমস্যা দ্রুত উন্নতি হতে থাকে। আমাদের দেশে বিভিন্ন বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের একটি অংশ কুইক রেন্টাল সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এবং কল কারখানা সার্বক্ষণিক চালু রাখার লক্ষ্যে সরকার সে সময় কুইক রেন্টাল সিস্টেম চালু করে সারা দেশে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেয়। সেসময় কুইক রেন্টাল ব্যবস্থায় না গেলে অর্থনীতির চাকা যেমন থমকে যেত তেমনি জনগণের দুর্গতি হত অবর্ণনীয়।
আগেই বলেছি প্রয়োজন অনুযায়ী দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য প্রতিদিন সারা দেশে সাময়িক সময়ের জন্য লোডশেডিং এর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যুদ্ধের কারণে বিশ্বময় যে তীব্র সংকট চলছে তা থেকে উত্তরণের জন্য জনগণকে মিতব্যয়ী হতে হবে। রোধ করতে হবে অপচয়। আমাদের প্রতিটি বাসা বাড়িতে অসতর্কতা, অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অপচয় হয়। এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। সম্পদ হচ্ছে আমানত। সেটা ব্যক্তির হোক বা সরকারি হোক। যার যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি ব্যয় বা খরচ করলে সেটা অপচয়। পবিত্র কোরান শরীফে সুরা বনী ইসরায়েলের ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘নিশ্চয়ই অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। শয়তান তার প্রতি পালকের প্রতি অতিশয় অকৃজ্ঞ’। লেখাটি শুরু করেছিলাম বৃক্ষমেলায় বিদ্যুতের অপচয় নিয়ে। তাই যারা অপ্রয়োজনে খরচ করে বা অপচয় করে তাদের উদ্দেশ্যে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের কবিতার এই অংশ উদ্ধৃত করে শেষ করছি। ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ বাতি।
লেখক : রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআশুরার ইতিহাস গৌরবের, গ্লানির নয়
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু এবং আজকের বাংলাদেশ