বুয়াদের চার গ্যাং নগর দাপাচ্ছে

জড়িত ৪শ নারীর ৭৩ জন পেশাদার ছিনতাইকারী ।। পাঁচ বছরে ৩৯০ চুরি ও ৬১ ছিনতাই

| শনিবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

জড়িত ৪শ নারীর ৭৩ জন পেশাদার ছিনতাইকারী ।। পাঁচ বছরে ৩৯০ চুরি ও ৬১ ছিনতাই

ঋত্বিক নয়ন

বুয়া পরিচয়ে চুরি’ চক্রের ৪ সদস্যকে ৩৪ ভরি স্বর্ণসহ গত ৪ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করেছে সিএমপি ডিবি (উত্তর ও দক্ষিণ)। তাদের দলনেত্রী বকুল ওরফে রাশেদার বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। পুলিশ জানায়, গত ৩ ডিসেম্বর পাঁচলাইশ থানাধীন ষোলশহর ২ নং গেট এলাকার ফিনলে স্কয়ার ভবনের ৯ তলার একটি ফ্ল্যাটে রাশেদা ছদ্মবেশী পারুল নামে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা শুরু করে। এরপর ১৭ ডিসেম্বর বাসায় কেউ না থাকার সুযোগে আলমারি ও লকার ভেঙ্গে ১০০ ভরি স্বর্ণালংকার ও ৬০ হাজার টাকা চুরি করে পালিয়ে যায়। ডিবি পুলিশ জানায়, ২০১৩ সালের রাজধানীর গুলশান থানার একই রকম একটি চুরির ঘটনাকে সূত্র ধরে রাশেদাকে শনাক্ত করে রাজধানীর আদাবর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাশেদা জানায় সে ২০১৩ সাল থেকে প্রতারণার মাধ্যমে চুরির সঙ্গে জড়িত। দেশব্যাপী তাদের একটি চক্র আছে। সে তার চক্রের সদস্যদের সাথে মিলে বিভিন্ন বাসায় কাজের লোক হিসেবে নিয়োজিত হয়। পরে সুযোগ মতো বাসার লোকজনকে অচেতন করে বাসার স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে নিয়ে যায়। এর আগে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একই রকম আরো ঘটনা ঘটিয়েছে সে ও তার গ্রুপ।

বকুল একা নয়। তার মতো নগরী ও শহরতলীতে দুঃসাহসিক চুরিতে জড়িত ৪০০ নারী। পাঁচ বছরে নগর ও শহরতলীতে ৩৯০টি চুরির ঘটনা সংঘটিত করেছে এ ৪০০ নারী চোর। পুলিশের চোখে এর মধ্যে চুরিতে সিদ্ধহস্ত ‘বুয়া গ্যাং’। চুরি ছাড়াও ছিনতাইয়েও পেকেছে নারীর হাত। সব মিলিয়ে ছিনতাইয়ে কবজির জোর দেখাচ্ছে পেশাদার ৭৩ নারী ছিনতাইকারী। চার গ্যাংয়ের ছায়ায় নগর দাপাচ্ছে তারা। পুলিশের নথি বলছে, পাঁচ বছরে অন্তত ৬১ ছিনতাইকর্ম সেরেছে গ্যাংগুলো। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, ছিনতাইয়ের এই সংখ্যা আরও কয়েকগুণ বেশি।

চুরিকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ‘বুয়া গ্যাং’। তাদের টার্গেট বাসাবাড়ি। আবার অপর একটি চক্র আছে ভিক্ষা করার ছলে করে চুরি। ভিক্ষা চাওয়ার নামে ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে চুরি করার এক জাদুকরি শক্তি আছে তাদের একটি চক্রের। ভিক্ষা দিতে বাড়ির মানুষ যখন ভেতরে ঢুকে তখনই ওই ঘর থেকে দামি জিনিস নিয়ে হাওয়া হয়ে যায় তারা! চুরির জন্য তাদের প্রথম পছন্দ মোবাইল ফোন। পাঁচ বছরে ৩৯০ চুরির ঘটনায় ৪০০ নারী চোর গ্রেপ্তার হয়েছে চট্টগ্রামে।

পুলিশের হিসাবে ৬১ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৭৩ নারী গ্রেপ্তার হয়েছে। যেখানেই নারীর সর্বস্ব ছিনতাই, সেখানেই পুলিশ চার নারী গ্যাংয়ের সদস্যদের খুঁজে। নারীর ছিনতাই মানে এর সঙ্গে ছায়া হয়ে থাকে নাসিরনগর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া কিংবা কঙবাজারের গ্যাং। ছিনতাই করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে বারবার কারাগারে গেলেও জামিনে বেরিয়ে তারা ফের খুঁজে পুরোনো অন্ধকার পথ।

পুলিশের ভাষ্য, ছিনতাইকর্মে সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের ধরমন্ডল গ্যাং। নগরীতে ছিনতাইয়ে জড়িত ধরমন্ডল গ্যাংয়ের ছড়ি ঘুরাচ্ছে মরিয়ম, রাহেলা, জোহানা, কহিনুর, রোজিনা, রহিমা, মর্জিনা, সোমা, সাবিনা, পম্পি, রোকসানা ও কোহিনুর। কুমিল্লা গ্যাংয়ে রয়েছে বকুল ওরফে রাশেদা, আয়েশা, কেয়া, স্বপ্না, মর্জিনা, আয়েশা, রুমা, রেখা, হেনা, মেরি, রিংকি, ফাতেমা ও পারুল। কুষ্টিয়া গ্যাংয়ে আছে পাপিয়া, রহিদা, ববিতা, শান্তাসহ ৯ নারী। কঙবাজার গ্যাংয়ের হয়ে নুর ফাতেমার নেতৃত্বে স্বপ্না, শাহনাজ, কুলসুমাসহ ১৩ নারী ছিনতাই করছে।

পাঁচ কৌশলে তারা ছিনতাই করে। নগরীর ব্যস্ততম মার্কেটে ক্রেতা সেজে ঘোরাঘুরি করে প্রথমে টার্গেট করে। সুযোগ বুঝে ছিনতাই চলছে নিয়মিত। যাত্রীবেশে গাড়িতে উঠে অন্য যাত্রীর শরীরের ওপর বমি করার অভিনয় করে টার্গেট করা যাত্রীকে প্রথমে অপ্রস্তুত করে ফেলা হয়। পরে ছিনিয়ে নেওয়া হয় সোনার চেনসহ অন্যান্য জিনিস। রাস্তায় হাঁটার সময় কৃত্রিম জটলা পাকিয়ে চোখের পলকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় সর্বস্ব। এ ছাড়া নির্জন রাস্তায় চোখের পলকে চারপাশ থেকে এমনভাবে ঘিরে ফেলা হয়, বাইরে থেকে কারও টের পাওয়ার উপায় থাকে না কী ঘটছে। চক্রের নারীরা সবসময় দলবেঁধে চলাফেরা ও ছিনতাই করে। নগরীর ব্যস্ততম এলাকা টেরীবাজার, নিউমার্কেট, সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লা ও লালদীঘির উত্তর পাড় হকার্স মার্কেট এলাকায় বেশি ছিনতাই করছে তারা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলোজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, অপরাধপ্রবণ পুরুষের মাধ্যমেই নারীরা ছিনতাই ও চুরিতে নাম লেখাচ্ছে। একবার যে নারী চুরিছিনতাই করে অভ্যস্ত হচ্ছে, সে আর এ কাজ ছাড়তে পারছে না। এটাকেই উপার্জনের একমাত্র পথ হিসেবে বেছে নিচ্ছে। তাদের এই অপরাধ থেকে ফেরাতে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতাও পালন করা জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনেপালকে হারিয়ে শুরু বাংলাদেশের
পরবর্তী নিবন্ধবইমেলার সকালটা শিশুদের, সন্ধ্যায় জনসমুদ্র