আজ শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা। বিশ্বের বৌদ্ধদের সর্ববৃহৎ দিন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম, বোধিলাভ ও মৃত্যু একই তিথি বৈশাখী পূর্ণিমায় সংঘটিত হয়েছিল বিধায় এটা বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা। সেজন্য এই পবিত্র দিনের গুরুত্ব ও আবেদন অতীব গম্ভীর। বুদ্ধের আগমন হয়েছিল মানবকল্যাণে এবং মানবতাবাদের উদ্বোধনে এই পবিত্র পূর্ণিমায়। তার শাশ্বতবাণী তার জন্মের আড়াই হাজার বছরের পরে হলেও আজও প্রাসঙ্গিক। আমরা এই পবিত্র দিনে দেশবাসীকে মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম মানবতাবাদের প্রেরণা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল। সে সময় ছিল ধর্মের নামে শোষণ এবং চরম জাতিভেদ। মানুষের জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখই ছিল বেশী। মানুষের এই দুঃখ দেখেই দুঃখমুক্তির সন্ধানে তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন। তার তো কোন অভাব ছিলনা, তিনি ছিলেন রাজপুত্র, কিন্তু মানবকল্যাণে তিনি সাধনায় নিমগ্ন হন। উনত্রিশ বছর বয়সে পিতামাতা, সিংহাসন, রাজ্য, রাজত্ব, প্রজা, সবার আকর্ষন ত্যাগ করে শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমায় গৃহত্যাগ করেন। এ যেন রাজার দুলাল আজি বনবাসে যায়রে। কবি বললেন:
রাজ্য তাকে ছেড়ে দিল পথ
প্রিয়া তাকে রুটিলনা
রুধিলনা সমুদ্রপর্বত।
গৌতম বুদ্ধ মানুষকেই বড় করে দেখেছিলেন, মানুষের দুঃখের কথা ভেবেছিলেন। পৃথিবীতে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু আছে, এগুলি দুঃখ, এদের থেকে মুক্তি দরকার।
গৌতম বুদ্ধের মূল লক্ষ হলো মানবকল্যাণ, আদর্শ হলো মানবতাবাদ। মানবতা চর্চার প্রধান অনুশীলন হচ্ছে, মানুষের গভীরে প্রবেশ করে তাকে আলোকিত করা। সেজন্য মানুষকে প্রজ্ঞাবান হতে হয়, অজ্ঞানতাকে জয় করতে হয়। মানুষকে হতে হয় প্রাণিত, বন্ধু ও মানবের কল্যাণমিত্র।
মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা হলো মানবতার শ্রেষ্ঠ প্রয়োগ। সেজন্য মানুষকে হতে হয় মৈত্রী পরায়ণ, সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী, তার কল্যাণের জন্য ত্যাগ, হলো বৌদ্ধধর্মের মূল্যবান আহ্বান। প্রাণীর প্রতি মৈত্রী, অপরের দুঃখে দুঃখী হওয়া,অপরের উল্লাসিতে। আনন্দিত হওয়া, রাগ, দ্বেষ, মোহকে জয় করাই মানবতাবাদ।
বৌদ্ধধর্মে বর্ণবৈষম্য নাই, জাতিভেদ নাই। মানুষ জন্মের দ্বারা নহে, কর্মের দ্বারাই শ্রেষ্ঠ হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু আনন্দ পিপাসার্ত হয়ে এক চন্ডাল কন্যা’র কাছ থেকে জল চাইল তৃষ্ণা মেটাতে। এই প্রস্তাবে চন্ডালকন্যা সংকোচিত হয়, বলল প্রভু, আমাকে ক্ষমা করুন, আপনাকে জল দিতে পারবো না, কারণ আমি অস্পৃশ্যা। আনন্দ বলে, কে বলে তুমি অস্পৃশ্যা, হে কন্যা আমি পিপাসার্ত, আমি যে মানব, তুমিও সে মানব, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। এই বাক্যে চন্ডাল কন্যা আপ্লুত হয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুকে পিপাসা নিবারণের জন্য জল দিয়েছিল। এ কাহিনী মানবতার পরিচয় তুলে ধরে।
মানবতা হলো মানবপ্রেম, মানুষের প্রতি মৈত্রী পরায়ণ হওয়া, মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। বুদ্ধ বলেছেন, অসাধুকে সাধুতার দ্বারা, মিথ্যাকে সত্যের দ্বারা, কৃপণতাকে ত্যাগের দ্বারা জয় করতে হয়। তাই বৌদ্ধধর্ম মানুষকে বৈরীদের মধ্যে অবৈরী হয়ে, দুঃখীর মধ্যে দুঃখহীন হয়ে, শোকপ্রাপ্তদের মাঝে শোকহীন হয়ে, হিংসকদের মাঝে অহিংস হয়ে জীবন যাপন করা। এ জীবনই আদর্শ জীবন, এ জীবনই মানবিকতায় পরিপূর্ণ। মাতা যেমন তার অসুস্থ পুত্রকে নিজের আয়ূদিয়ে বাঁচাতে চায়, ঠিক তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় মৈত্রী পোষণ করবে। এখানেই তো মানবপ্রেম, মৈত্রী ও মানবিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
বুদ্ধ ছিলেন মানবদরদী, সেজন্য তার বাণীগুলি, উপদেশগুলি মানবকল্যাণে উৎসারিত। তিনি বাস্তববাদী ছিলেন, অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম প্রায়োগিক ধর্ম। তিনি বলেছেন, ক্ষুধা পরম রোগ, এই রোগকে সারাতে হবে, মানুষের জন্য অন্নের ব্যবস্থা করে। তিনি আরো বলেছেন, যে রোগীর সেবা করে, সে ধর্মের সেবা করে, মানুষের কল্যাণ করে।
বুদ্ধ পাপীকে নয়, পাপকেই ঘৃনা করতে বলেছেন। একটা গল্প দিয়ে তার ব্যাখ্যা দিতে চাই। গৌতম বুদ্ধ তার শিষ্যসহ পরমাসুন্দরী নগররক্ষিতা আম্রপালীর বাগানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ খবর পেয়ে আম্রপালী আনন্দিত হয়, সাথে সাথে আম্রকাননে এসে বুদ্ধকে ভক্তিভরে বন্দনা (প্রণাম) করে। বুদ্ধ তাকে আশীর্বাদ করেন, এতে আম্রপলী আনন্দিত হয়, পরদিন তার বাড়িতে খাওয়ার জন্য বুদ্ধসহ শিষ্যদের আমন্ত্রণ করেন। বুদ্ধ তা গ্রহণ করেন। এই খবর শুনে স্থানীয় ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তার (বুদ্ধ) কাছে ছুটে আসেন এবং নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করতে সবিনয়ে প্রার্থনা করেন, তারা বলেন, সে বারবনিতা, ঘৃণার কাজ করে, সমাজে অস্পৃশ্যা। বুদ্ধ বললেন, মানুষ মানুষ হয়ে জন্মায়, তাকে অবস্থা ও পরিবেশ খারাপ করে। তাদের যদি সত্য পথের নির্দেশ দেয়া যায়, তারাও সৎ জীবন যাপন করতে পারে। তিনি বলেন, হে সমাজপতিগণ, হে ধনীগন, শুনুন, পাপীকে নয়, পাপকেই ঘৃণা করবেন। পাপী যদি সুযোগ পায়, সেও আদর্শ জীবনের অধিকারী হতে পারেন।
রাজা প্রসেনজিত কন্যা সন্তান হওয়ায় সুখী হননি। একথা শুনে বুদ্ধ রাজাকে বললেন, হে রাজন, কন্যা সন্তানও সন্তান। সে যদি ছেলেদের মত সুযোগ পায়, তবে সেও পুরুষের মতো কীর্তিমান হতে পারে। পুত্র ও কন্যার মধ্যে প্রভেদ করবেন না। বৌদ্ধধর্মে নারীরও সমঅধিকার রয়েছে।
বুদ্ধ আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ নিজের প্রভু নিজেই নিজের উদ্ধারকর্তা, এভাবে বৌদ্ধধর্ম মানুষকে বড় করেছে। বুদ্ধের কালজয়ী আহ্বান হলো ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক’– এখানেই তো মানবপ্রেম ও মানবতাবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি মানুষের মর্যাদা সম্পর্কে ড. জিসি দেব বলেছেন, তিনি একজন মানবতাবাদী। অধ্যাপক আবুল ফজল লিখেছেন, বৌদ্ধধর্ম একমাত্র ধর্ম যা মানুষের তৈরি এবং সর্বতোভাবে মানুষকে নিয়ে। বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, বুদ্ধ মানুষের আত্মশক্তি প্রচার করছিলেন। ড.রাধাকৃষন বলেছেন, সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী পোষণ করিও-এটা বুদ্ধ নির্দেশিত। এভাবে বিশ্বের অনেক জ্ঞানী, গুণী বুদ্ধের মৈত্রী ও মানবপ্রেমের কথা লিখেছেন।
বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের সর্ববৃহৎ উৎসব। এ পবিত্র দিনে বৌদ্ধেরা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বৌদ্ধভিক্ষুদের দান-দক্ষিণা দেয়, পঞ্চশীল গ্রহণ করে। শীল হলো, চরিত্র গঠনের দীক্ষা। একটি ব্রত বিশেষ, যথা হত্যা, চুরি, কামাচার, মিথ্যা কথা ও মাদক দ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা। বিকেলে ধর্মসভার মাধ্যমে বুদ্ধ চর্চা হয়, মৈত্রীর আহ্বান জামানো হয়, সন্ধ্যায় প্রদীপ জালানো হয়। এর মমার্থ হলো, প্রদীপ যেমন অন্ধকার দূরীভূত করে, তেমনি জ্ঞানপ্রদীপের মাধ্যমে মানুষের মন থেকে হিংসার অবসান চর্চা হয়। সে সাথে দেশ, জনগন ও বিশ্বের শান্তি কামনা করা হয়।
বাংলাদেশ সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির দেশ। এ দেশে ধর্মে ধর্মে বর্ণে বর্ণে কোন বিরোধ নাই। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ পরম শান্তিতে বসবাস করে। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দেন, এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বৌদ্ধদের পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও বুদ্ধ পূর্ণিমার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
বৌদ্ধধর্ম শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম। বুদ্ধের বাণী হল, জগতে শত্রুতার দ্বারা শত্রুতাকে জয় করা যায় না। শত্রুতাকে মৈত্রী দিয়ে জয় করতে হয়। সেজন্যই মৈত্রী অনুশীলন করতে হয়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর পূর্বে গৌতম বুদ্ধ অহিংসা মৈত্রী ও মানবতার বানী প্রচার করেছেন। অহিংসা হল সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমেয় মৈত্রী পোষণ করা। অথচ আজ বিশ্বে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে, নিপীড়ন করছে, অপমানিত করছে, দুর্নীতিকে লালন করছে। তাই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য আজ এই পূর্ণময় দিনে বুদ্ধের মহামানবতাবাদকে স্মরণ করছি।
বৌদ্ধরা এদেশের ভূমিজ সন্তান। বৌদ্ধদের মধ্য দিয়েই বাংলা ভাষার আদি গ্রন্থ চর্যাপদ রচিত হয়েছে। বৌদ্ধরা এ দেশকে ভালোবাসে। তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বানে বৌদ্ধরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুখী সমৃদ্ধশালী অসামপ্রদায়িক সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। সে সাথে দেশের সকল সমপ্রদায়ের মানুষের প্রতি বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছে।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ