আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা, বাঙালীর যা বৈশাখী পূর্ণিমা, বৌদ্ধদের তা বুদ্ধ পূর্ণিমা। এই পবিত্র দিনে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন, হয়েছিলেন মহাজ্ঞানী। এছাড়া তিনি এই পূর্ণিমায় জন্মগ্রহণ করেন এবং এই পূর্ণিমা মৃত্যুবরণ করেন অর্থাৎ মহাপরি নির্বাণ লাভ করেন। এই পূর্ণিমায় তিথিতে মহামতি বুদ্ধের অবদান হলো, মানবতা সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতি। এই পবিত্র দিনে আমি সকলের প্রতি মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সকলের অন্তর মৈত্রীর আভায় আলোকিত হউক।
বাংলাদেশ সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির দেশ। এখানে ধর্ম পালনে কোন বাধা নাই। সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের মতো আমরাও এ দেশে বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন করছি। এতে মাননীয় রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধদের শুভেচ্ছা জানান। রাষ্ট্রের এক আদর্শ হলো ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।
বুদ্ধ ছিলেন নেপালের কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্বোধনের সন্তান। যথাসময়ে বিবাহ করেছিলেন এবং এক পুত্র সন্তানও ছিল। শৈশব থেকেই তার চিন্তাগ্রস্ত মন। অপরের দুঃখ দেখলে কষ্ট পেতেন। তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন, নগর পরিক্রমায় বের হয়ে দেখলেন ব্যাধিগ্রস্ত, জরাগ্রস্ত মৃত্যু ও সংসার ত্যাগী এক সন্ন্যাসীকে। এতে তার মন বিচলিত হয়, চিন্তার উদয় হয়। জরা ব্যাধি মৃত্যুকে জয় করার জন্য তিনি সংসার ত্যাগ করলেন, গৃহত্যাগের পূর্বে পিতার অনুমতিও নিয়েছিলেন। দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার পর তিনি এরকম এক বুদ্ধ পূর্ণিমায়, ভারতের বিহার রাজ্যের উরুবেলা গ্রামে এক অশ্বথবৃক্ষের নীচে বসে, ধ্যানরত অবস্থায় তিনি মহাজ্ঞান লাভ করলেন, গৌতম হলেন বুদ্ধ। আজ তাকেই আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
বুদ্ধ মানুষকে আদর্শ জীবনে উন্নীত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বৌদ্ধধর্মে এর নাম হল ব্রহ্মবিহার। ব্রহ্মবিহারের ভাবনা হলো, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষার ভাবনা। এই ভাবনার মধ্য দিয়েই মানুষ আদর্শ জীবনে উন্নীত হয়। যা আজকের দিনে খুবই দরকার। সকল প্রাণীর হিত ও সুখ কামনাই হলো মৈত্রী ভাবনা। এটা হল প্রেম প্রীতি পরোপকার ও ভালোবাসা। সকল প্রাণী সুখী হোক, নিরোগ হোক, শত্রুহীন হোক, যথালদ্ধ সম্মতি লাভ করুক। মৈত্রী ভাবনা হল, প্রকৃত বন্ধুর মতো অপর মানুষের মঙ্গল কামনা করা। সকল জীবের প্রতি করুণার অপর নাম মৈত্রী। মৈত্রীর মাধ্যমে পৃথিবী হয় সুখের। করুণা হলো অপরের দুঃখে দুঃখী হওয়া। অপরকে দুঃখ থেকে উত্তরণের জন্য সহায়তা করা। সে সাথে অপরের দুঃখকে অপনোদনের জন্য সহায়তা করা। মুদিতা হলো অপরের সুখে সুখী হওয়া, অপরের দুঃখ অপনোদনের চেষ্টা। মানুষের মনে করুণার উদ্রেক হলে তা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য কাজ করে। উপেক্ষা হল লোভ– দ্বেষ, মোহ বর্জিত নিরপেক্ষ অবস্থান, নিন্দা প্রশংসা, যশ–অযশ, সুখ–দুঃখ লাভ–ক্ষতিতে অবিচল থাকা। এই চার ভাবনা দ্বারা মানুষ আদর্শ জীবনে উন্নীত হয়। আজকের দিনে আমাদের কামনা মানুষ যেন ব্রহ্মবিহারে উন্নীত হয়। এই পথ ধর্মীয় পথ, এই পথ গৌতমের পথ।
বুদ্ধ রাজনৈতিক নেতা নন, তিনি ধর্মীয় নেতা। তিনি বিহারের বৃজিরাজকে রাজ্যের অখণ্ডতা ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য এবং অধিকতর শক্তিশালী হওয়ার জন্য সাতটি ধর্ম ও প্রতিপালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেগুলো হলো, ১– সদা সর্বদা সভা সমিতিতে একত্রে মিলিত হওয়া, ২– একমত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, ৩– দেশের ভালো নীতিগুলি রক্ষা করা এবং অকল্যাণকর নীতি প্রচলন না করা, ৪– জ্ঞানীগুণী ও বয়োবৃদ্ধদের সম্মান করা, ৫– নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ৬– রাজ্যের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় স্থানগুলি রক্ষা করা, তাদের সম্পদ আত্মসাৎ না করা এবং ৭– নিজ দেশের এবং অন্যান্য দেশের গুণীজনদের সম্মান করা।
আজকের দিনে এ সমস্ত নির্দেশাবলীর প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করি। বুদ্ধ পূর্ণিমার পবিত্র দিনে প্রত্যাশা করি বিশ্বের যে কোন রাষ্ট্র যদি এ সমস্ত নিয়ম নীতি মেনে চলে, তাহলে সে সব দেশের উন্নতি হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এই আলোকে দেশ শাসন করে গেছেন, বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের অন্তরালে এমন নির্দেশাগুলির ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
বুদ্ধ ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, তিনি মানব কল্যাণ ছাড়া, অন্য কোন চিন্তাই করতেন না। বুদ্ধের নীতি পালনের জন্য বৌদ্ধ হতে হয় না, এটা সকলের এবং সার্বজনীন।
বাংলাদেশে সকল ধর্মের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, বুদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধদের বঙ্গভবন ও গণভবনে সংবর্ধনা দেন, বাণী দেন। বৌদ্ধরা এদেশের প্রাচীন অধিবাসী। তারাও সাধ্যানুসারে দেশের শ্রীবৃদ্ধির জন্য অবদান রেখে যাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে বৌদ্ধরা স্বাধীনভাবে বসবাস করছে। এই শুভদিনে আমরা বাংলাদেশের সকল জনগণকে মৈত্রীময় শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বৌদ্ধরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন আদায়ের জন্য ভূমিকা রেখেছে। আমিও সেই দায়িত্ব পালন করি। দেশ স্বাধীন হয়েছে, অনেক এগিয়েছে, কিন্তু আজও প্রত্যাশিত স্তরে উন্নতি হয়নি। জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ দেশ স্মার্ট সোনার বাংলা হবে। এই মহান বুদ্ধ পূর্ণিমায় তাহাই কামনা করছি। আজ প্রত্যয়ের সাথে স্বীকার করছি, সরকার বৌদ্ধদের সার্বিক কল্যাণে অবদান রেখে যাচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অপরের কল্যাণ ছাড়া এক নিঃশ্বাসও নেননা। তার নিরাময় ও দীর্ঘ জীবন কামনা করছি। তার কল্যাণ হোক, দেশের শ্রীবৃদ্ধি হোক।
সর্বগ্রাসী ক্ষুধানল উঠিয়াছে জাগি
পীড়িত মানুষ মুক্তিহীন
পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে স্থির
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠেছে অবিরাম
বুদ্ধের স্মরণ লইলাম।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক বাংলাদেশের সমৃদ্ধি হোক।
লেখক: একুশে পদক প্রাপ্ত শিক্ষাবিদ ও উপদেষ্টা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ