(প্রথম পর্ব)
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রসঙ্গ এলেই অবধারিতভাবে যে-দুটো বিষয় উঠে আসে, কবিতা ও চলচ্চিত্র। তিনি কবি বলেই যে তাঁর চলচ্চিত্রকে কবিতার সঙ্গে তুলনা করা হয় তা নয়, তাঁর চলচ্চিত্রের উপরি কাঠামো অন্তর্নিহিত সারবস্তুর গুণেই এই পারস্পরিক উপমা শুরু থেকেই উচ্চারিত হয়ে এসেছে। বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতা এমনভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত তাঁর ছবিতে, পরাবাস্তব বাস্তব হয়ে যেমন ধরা দিত, তেমনই বাস্তব হয়ে উঠতো পরাবাস্তব। তাঁর কবিতাও ঠিক তেমনই, বিমূর্ততা আর মূর্তর অনায়াস এক অবগাহন। তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের কথা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের এই মনস্বিতা তাঁকে যেমন ‘চলচ্চিত্রের কবি’ অভিধায় বিশেষায়িত করে তুলেছিল, তেমনইভাবে বাংলা চলচ্চিত্রে সৃষ্টি করেছিল এক ভিন্নরকমের ঘরানা, যেটি বোধের স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ। শেষ ছবিটিও তিনি করতে যাচ্ছিলেন পুরোপুরি কবিতাকে নির্ভর করে। জীবনানন্দের কবিতা ও তাঁর নিজের কবিতার সমন্বয়ে চিত্রনাট্য রচনা শেষ করেও কোভিডের দ্বিতীয় আক্রমণের কারণে স্যুটিং আর শুরু করা সম্ভব হয়নি। বাংলা চলচ্চিত্র বঞ্চিত হলো অভিনব এক সৃষ্টি থেকে।
১৯৮৪ সালে ধীমান দাশগুপ্ত তাঁর নতুন বাংলা সিনেমা গ্রন্থে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তাঁর ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য এর নির্মাণ কর্ম, আমি গঠন কাঠামোর দিক থেকে বলছি, যে অর্থে তাঁর ছবি সুগঠিত চলচ্চিত্র। দুই প্রান্তের দু’টি বিপ্রতীপ বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ/বিকর্ষণের দ্বন্দ্বে তাঁর ছবি টেনশনের ছবি। একটু রোমান্টিক তবু শিল্প মেজাজের দিক থেকে বুদ্ধদেবই সত্যজিতের সব চাইতে কাছাকাছি। ধীমান বাবু যখন বুদ্ধদেব বাবু সম্পর্কে এই মূল্যায়ন করেছিলেন তখন তিনি কাহিনীচিত্র নির্মাণ করেছেন মাত্র চারটি; দূরত্ব (১৯৭৮), নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯), গৃহযুদ্ধ (১৯৮২) এবং শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি (১৯৮২)। অবশ্য এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র ও শুরুতেই একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনী চিত্র (সময়ের কাছে, ১৯৬৮) নির্মাণ করেছেন।
প্রথম ছবিতেই তিনি তাঁর জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র দূরত্ব ১৯৭৮ সালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে সমর্থ হয়। দূরত্ব ১৯৭৮ সালের শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্রের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ১৯৭৯ সালে লোকার্নোর ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে।
ছবিটি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে নির্মিত যেখানে মানবিক সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন অত্যন্ত দরদ দিয়ে চিত্রায়িত। দ্বিতীয় ছবি যেটি কমল কুমার মজুমদারের ছোট গল্পের চিত্ররূপ, নিম অন্নপূর্ণাতে এই টানাপোড়েন আরো ভয়ংকরভাবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, ইন্দ্রিয়স্পৃহা এসব প্রবৃত্তির দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে চিত্রিত। এই ছবিও কার্লোভি ভেরিতে বিশেষ জুরি পুরস্কার এবং লোকোর্নোয় জুরি পুরস্কার পায়। দুই উৎসবেই ছবিটির মানবিক গুণাবলীর প্রশংসা করা হয়। মানবিক গুণাবলীর সমৃদ্ধতা তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে লক্ষণীয়। যদিও একেক ছবিতে তার প্রকাশ একেকরকম। এবং প্রতিটি ছবিই স্বাতন্ত্রিক মর্যাদার মাপকাঠিতে স্বতন্ত্র। বাস্তব ও পরাবাস্ততার অনায়াস মিশেল বুদ্ধদেবের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য (এটা অবশ্য পরিলক্ষিত হয় তাঁর ৭ম কাহিনীচিত্র ‘ফেরা’ থেকে) হলেও প্রত্যেকটি ছবিতে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করা যায়। প্রত্যেকটি ছবিতে তিনি নিজেকে ভেঙেছেন এবং নতুনভাবে গড়েছেন। এটা তাঁর কবিত্বের সহজাত বহিঃপ্রকাশ।
উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি বুদ্ধদেবের আরেকটি উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য কাব্যময়তা, যা তাঁর চলচ্চিত্রে পরতে -পরতে থাকে প্রতিটি ফ্রেমের কম্পোজিশনে, দৃশ্যের মিজঁসীনে, চিত্রনাট্যের গড়নে, সম্পাদনায়, সংগীতে, অভিনয়ে, রঙের ও আলোর বিন্যাসে কিংবা সাদা কালোর সম্পাতে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত একজন খ্যাতকীর্তি কবি। বিষয় বৈচিত্র্য ও আঙ্গিক অভিনবত্বের উৎকর্ষে তাঁর কবিতাও গুণান্বিত। কবিতা থেকে চলচ্চিত্রে আসা ও তাঁর ছবির অন্তর্নিহিত কাব্যময়তা সম্বন্ধে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি ধীমান দাশগুপ্তকে বলেছিলেন, ‘আমি প্রথমে কবিতাই লিখতাম, পরে ফিল্মে আসি। আপনি নিশ্চয় দেখেছেন কোথাও কোথাও আমি পেরেওছি, কবিতার ব্যাপারটা ফিল্মে আনতে। যদিও আমি এমন বিষয় নিয়েও ছবি করেছি যা হয়তো সে অর্থে কবিতার ধারকাছ দিয়েও যায় না। আমার মনে হয়, সম্পাদনার দিক দিয়ে বলুন কি কোনো একটা দৃশ্যকে তুলে ধরা বা মুড তৈরি করার দিক দিয়ে বলুন কবিতা আমাকে ভীষণ সাহায্য করেছে। যে কোনো বড় পরিচালকই বা শিল্পীই কবি, কবিতা না লিখলেও। যেমন চ্যাপলিন বা আইজেনস্টাইন বড় কবি। আবার আমি যখন সিনেমায় আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হতে লাগলাম, লক্ষ করলাম আমার কবিতার বিষয় ও চেহারা পাল্টাচ্ছে। আমার কবিতার সিনট্যাক্স পাল্টাচ্ছে, শব্দ ভাঙা ও দেখার কোণ পাল্টাচ্ছে। বলতে পারেন এটা একেবারে ৎবপরঢ়ৎড়পধষ একটা ব্যাপার, কবিতা যেমন আমাকে প্রথম দিকে সিনেমার ব্যাপারে দারুণ সাহায্য করেছে, সিনেমাও তেমনি এখন আমাকে কবিতার ব্যাপারে ভীষণ সাহায্য করছে।’
সিনেমা করতে আসার পেছনে কী কী উদ্দেশ্য ও কারণ রয়েছে ধীমানা দাশগুপ্তের এই প্রশ্নের জবাবে বুদ্ধদেব জানিয়েছিলেন, ‘এমন অনেক বিষয় রয়েছে যা কবিতায় বা সাহিত্যে প্রকাশ করা যায় না, তার জন্য অন্য মাধ্যম দরকার। ফলে আমার মনে হয়েছিল : চলচ্চিত্র নয় কেন ? এই মাধ্যমটির প্রতি আমার প্রায় ছোটবেলা থেকে টান ও ভালবাসা ছিল। ফলে আমি আমার ভাবনা-চিন্তা প্রকাশের জন্য কবিতা ছাড়াও এই মাধ্যমটিকে গ্রহণ করার কথা ভেবেছিলাম।
বুদ্ধদেব বাবু এসব কথার সূত্র ধরেই চলচ্চিত্রে তাঁর আগমন এবং তাঁর চলচ্চিত্রের আঙ্গিকের সম্পর্কে আমরা সুস্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাই। মোট ২৪টি কাহিনী চিত্র ও ১৩ টি প্রামাণ্যচিত্র তিনি নির্মাণ করেছেন। প্রথম ছয়টি ছবি নির্মাণের পর থেকে তিনি ন্যারেটিভ ফর্ম থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ফর্মটি গড়ে তোলেন, যে ফর্মের মধ্যে থেকেই তিনি নিজেকে ভেঙেছেন গড়েছেন এবং পরবর্তী ১৮টি ছবি নির্মাণ করেছেন। সেদিক থেকে বলা যায়, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের উপর সত্যজিৎ রায়ের যে প্রভাবের কথা ধীমান দাশগুপ্ত উল্লেখ করেছিলেন, সেটা ৭ম ছবি ‘ফেরা’ থেকে আর লক্ষণীয় হয়নি। এই ছবি থেকেই বুদ্ধদেবের নিজস্ব ঘরানা তৈরি হয়ে যায়।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিগুলো হচ্ছে, সময়ের কাছে (স্বল্পদৈর্ঘ্য, ১৯৬৮), দূরত্ব (১৯৭৮), নিম অন্নপূর্ণা (১৯৭৯), গৃহযুদ্ধ ( ১৯৮২), শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি (১৯৮২), আন্ধি গলি (হিন্দি ১৯৮৪), ফেরা (১৯৮৮), বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯), তাহাদের কথা ( ১৯৯২), চরাচর ( ১৯৯৩), লাল দরজা ( ১৯৯৭), উত্তরা (২০০০), মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২), স্বপ্নের দিন ( ২০০৪), আমি ইয়াসিন আর আমার মধুবালা (২০০৭), কালপুরুষ (২০০৮), জানালা ( ২০০৯), মুক্তি (২০১২), চোলি কে পিছে (হিন্দি, টিভি ফিল্ম, ২০১২), অর্জুন (টিভি ফিল্ম, ২০১২) দি স্টেশন (হিন্দি, টিভি ফিল্ম, ২০১৩), আনোয়ার কা আজব কিস্্সা (হিন্দি, ২০১৩), টোপ (২০১৭) এবং উড়োজাহাজ ( ২০১৮)।
ছবিগুলির মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও তাহাদের কথা রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। বুদ্ধদেবের অন্যছবিগুলোর সঙ্গে কোনোভাবেই মেলেনা। গঠনের দিক থেকে চাঁছাছোলা। সম্পর্কের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন, মানবমনের অন্তনির্হিত অনুভূতির দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কের সংঘাতের বিষয়গুলি অত্যন্ত সাবলীলভাবে দেখা যায় দূরত্ব শীত গ্রীষ্মের স্মৃতি, আন্ধি গলি, ফেরা, বাঘ বাহাদুর, চরাচর, লাল দরজা, স্বপ্নের দিন, উড়োজাহাজ এসব ছবিতে। নিম অন্নপূর্ণা বুদ্ধদেবের সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের ছবি। মানুষের মূল ইন্দ্রিয় ক্ষুধার বিপ্রতীপে অত্যেন্দ্রিয়ের সংঘাত এ-ছবির উপজীব্য। কমলকুমার মজুমদারের দুঃসহ গল্পের অসাধারণ চিত্রায়ণ। তেমনি নরেন্দ্রনাথ দত্তের গল্প ফেরার চিত্রায়ন বুদ্ধদেবের আরেকটি দক্ষ পরিচালনা। একটি শিশু দুজন নিঃসঙ্গ মানব মানবীর সম্পর্কের জটিল আবর্তে গড়ে ওঠা এই ছবি অনেক প্রশ্নের সামনে দর্শককে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ ধরনের সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন কাজগুলির রূপায়নে বুদ্ধদেব অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন যা আরো দেখা যায় আন্ধগলি, চরাচর, লাল দরজা, বাঘ বাহাদুর, স্বপ্নের দিন প্রভৃতি ছবিতে।
তবে শেষ দুটি ছবি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকের। নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে ‘টোপ’ এবং নিজের লেখা গল্প নিয়ে ‘উড়োজাহাজ।’ অসাধারণ দুটি চলচ্চিত্র। এ দু’টি ছবিতেও মানবমনের সুবৃত্তি-কু-বৃত্তি, প্রতারণা, ভালোবাসা, চাওয়া পাওয়া, না পাওয়া, মনের গহীনের নানা আকাক্সক্ষার কথা দুর্দান্ত চিত্রনাট্যের কাব্যিক চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে তিনি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন সহজাত পারঙ্গমতায়। (ক্রমশ:)