বুকে পাথর বেঁধে ফিরে গেলেন অরিত্রের মা-বাবা

সাগরে নেমে নিখোঁজ । যাওয়ার আগে সমুদ্রপাড়ে আজান দেওয়া ও মোনাজাত করা হয়

শাহেদ মিজান, কক্সবাজার | সোমবার , ২১ জুলাই, ২০২৫ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অরিত্র হাসান কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গোসল করতে নেমে ভেসে গেছেন। হন্য হয়ে খুঁঁজেছেন তার বাবামাসহ স্বজনরা। ১৩ দিন পার হয়েছে। এখনো তার খোঁজ মিলেনি। একমাত্র সন্তানকে খুঁজে পেতে সমুদ্রপানে চেয়ে অরিত্রের মাবাবার হাহাকার আর আকুতি মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। টানা ১০ দিন সমুদ্রপাড়ে কেটেছে তাদের দিনরাত। তারা বারবার বলেছিলেন, অরিত্রকে সাগরে রেখে কীভাবে আমরা ফিরে যাব? কীভাবে থাকব তাকে ছাড়া?

তবে কঠিন বাস্তবতাকে পাশ কাটানো যায়নি। নিয়তির পরিহাস মেনে নিয়ে বুকে পাথর বেঁধে ছেলেকে সাগরে রেখে বাড়ি ফিরে গেছেন একমাত্র সন্তানকে হারানো এই অসহায় মাবাবা।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, সন্তানকে না পেয়ে এক বুক হতাশা আর কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন অরিত্রের মাবাবাসহ স্বজনরা।

বিচকর্মীদের সুপারভাইজার মাহবুব আলম বলেন, অরিত্রের নিখোঁজের দশম দিনে এক হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন অরিত্রের মাবাবা। হুজুরের পরামর্শ মতে, সমুদ্র সৈকতের নাজিরারটেক গিয়ে আজান দেওয়া হয় এবং ছেলেকে খুঁজে পেতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানিয়ে মোনাজাত করা হয়। এরপর দিন তারা কক্সবাজার ছেড়ে গেছেন। যাওয়ার সময় অরিত্রকে খোঁজা অব্যাহত রাখতে লাইফগার্ড ও বিচকর্মীদের প্রতি আকুতি জানান তারা।

প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষে পাঁচ বন্ধু মিলে কক্সবাজার ঘুরতে আসেন। গত ৮ জুলাই সকাল ৭টার দিকে হিমছড়ি সৈকতে তিন বন্ধু অরিত্র, সাদমান ও আসিফ সাগরে গোসল করতে নামেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ঢেউয়ে ভেসে যান তারা। সাদমানের মরদেহ পরে সৈকতে এবং একদিন পর আসিফের মরদেহ নাজিরারটেক পয়েন্টে ভেসে আসে। কিন্তু অরিত্রের খোঁজ এখনো মেলেনি। অরিত্র হাসান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং বগুড়া জেলার বাসিন্দা।

অরিত্রের বাবা সাকিব হাসান ডেইলি নিউ এজের সিনিয়র সাবএডিটর। কর্মসূত্রে পরিবার নিয়ে ঢাকা বসবাস করেন। নিখোঁজের দিন থেকে কক্সবাজারে এসে অবস্থান নিয়েছিলেন অরিত্রের মাবাবা, চাচাচাচিসহ অনেক আত্মীয়স্বজন। সবাই প্রতিদিন সমুদ্রপাড়ে ঘুরে ঘুরে খুঁজেছেন অরিত্রকে।

জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, ওয়াটার বাইক, স্পিডবোট ও ড্রোনের সাহায্যে ইনানী, হিমছড়ি ও এমনকি সোনাদিয়ার চর এলাকাসহ আশপাশের উপকূলে টানা ১০ দিন তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে। জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলমের নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস, পর্যটন পুলিশ, বিচকর্মী, লাইফগার্ড সদস্য ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা মিলে যৌথভাবে প্রতিদিন তল্লাশি চালায়। কিন্তু কোথাও অরিত্রের খোঁজ মিলেনি।

তল্লাশি অভিযানে থাকা সি সেইফ সুপারভাইজার মোহাম্মদ ওসমান বলেন, অরিত্রের নিখোঁজ হওয়া আমাদের হৃদয়ে দাগ কেটেছে। তাই আন্তরিকতার সাথে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হেঁটে উপকূল ও নদীর মোহনা এবং সাগরে তল্লাশি চালিয়েছি। এভাবে টানা ১১ দিন তল্লাশি চালিয়েছি। তার মাবাবা চলে গেছে। যাওয়ার সময় আমাদেরকে অনুরোধ করেছেন যেন আমরা তল্লাশি চালিয়ে যাই। তল্লাশি অব্যাহত রেখেছি।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম বলেন, নিখোঁজ হয়েছে ১৩ দিন পার হলো। অলৌকিক কিছু না ঘটলে তার বেঁচে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার মাবাবাও হয়তো মেনে নিয়েছেন অরিত্র আর বেঁচে নেই। তবে যাওয়ার সময় খুব করে অনুরোধ করেছেন যেন তল্লাশি চালিয়ে যাই। আমরা এখনো নানাভাবে খোঁজ রাখছি।

অরিত্রের বাবা সাকিব হাসানের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার একমাত্র সন্তানকে সাগরে ফেলে রেখে কীভাবে বাড়িতে ঘুমাই? এক বুক হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। বাড়ি এসে অরিত্রের জন্য এতিমখানায় খাবার বিতরণ ও কোরবানি দিয়েছি। আমার পুত্রকে খুঁজতে আমরা আবার কক্সবাজার আসব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধবদিকে কারাগারে পাঠালেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল