বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখতার আহমদ

মো. খোরশেদ আলম | শনিবার , ২১ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

৬০ এর দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোখতার আহমদ। আজ থেকে ৭৮ বছর আগে আগস্ট মাসের ৩১ তারিখ বাঁশখালী সাধনপুর ইউনিয়নের রাতাখোর্দ্দ মোজাফফরাবাদ অজপাড়া গায়ে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে এই বীরের জন্ম। তাঁর পিতার নাম আবদুল আলী সওদাগর, মাতা মাইমুনা খাতুন। ৪ ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৪র্থ। স্কুল জীবনে একজন দক্ষ ফুটবলার ছিলেন মোখতার আহমদ। রাজনীতিতে তাঁর পদার্পণ ১৯৬২ সালে কুখ্যাত হামিদুর রহমানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেইসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত অগ্রণী বাহিনীর গোপন সংগঠন (নিউক্লিয়াস) চট্টগ্রামের তিনি সদস্য নির্বাচিত হন। সেই সংগঠনের প্রধান ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। এম এ আজিজ এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ৬ দফা থেকে ১ দফার আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন দ্রুত কার্যকর করতেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের নীলনকশা হিসেবে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল তাঁর বিরুদ্ধে। তিনি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ সরকারি কমার্স কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। ’৬৭-’৬৮ সালে মোখতার আহমদ অবিভক্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামের জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। সেই সময় তার সাথে সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক রাজনৈতিক প্রবাদপুরুষ এস. এম ইউছুফ। ’৬৯ এর গণ আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলার আহ্বায়ক। তার এই কমিটিতে অন্যান্য যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন আব্দুল্লাহ আল নোমান চৌধুরী, আবু তাহের মাসুদ ও কবীর আহমদ চৌধুরী সহ নেতৃবৃন্দ। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে পৌঁছালে ১৮ মার্চ আন্দরকিল্লা বন্দুকের দোকান ও আইসফ্যাক্টরী রোডের অস্ত্রাগার তার নেতৃত্বে দখল হয়। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে মোখতার আহমদ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েন। সেই সময় আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কেন্দ্রীয় প্রধান ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। মোখতার আহমদ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পান। ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ঘোষণা শোনার পর তিনি চট্টগ্রামে এসে ছাত্রজনতাকে সাথে নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১নং সেক্টর কর্তৃক তিনি বাঁশখালী, আনোয়ারা ও কুতুবদিয়া থানার আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত হন। তাঁর নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে পরাস্ত করেন। আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক ছিলেন মোখতার ভাই। আমার মরহুম পিতা আবদুল মাবুদ সওদাগরকে তিনি মামা বলে সম্বোধন করতেন। সেই সূত্রে আমি ছিলাম তার মামাত ভাই। পারিবারিক সম্পর্কের কারণে মোখতার ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন। পশ্চিম মাদারবাড়ি জব্বর সওদাগরের বাড়ি ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। আঙ্গুর ভাবী ছিলেন আমার পরম আত্মীয় এবং তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মোখতার ভাই অনেক বড় মাপের নেতা ছিলেন। কিন্তু কোনোদিন তার মাঝে কোনো অহংকার দেখিনি। ১৯৭৩ সালে মোখতার ভাই চট্টগ্রাম১৬ (বাঁশখালী) আসনে জাসদ থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করেন। ’৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তার ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ছিল। ১৯৮২ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ১৫ দলীয় জোটের একটি গোপন বৈঠক থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৬ সালে স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি আবার গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘদিন কারাবন্দী ছিলেন। ১৯৮৮ সালে আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়া আসনে জাসদ থেকে এম পি নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে মোখতার ভাই আখতারুজ্জামান বাবুর হাত ধরে জাসদের কয়েকশ নেতা কর্মী নিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগ এ ফিরে আসেন। বন্দর রেস্ট হাউজে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ঐসময় তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ এর কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে জামাতবিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে অমানুষিক নির্যাতন ও জুলুম অত্যাচার। পুলিশের বাধার কারণে কোথাও মিছিল মিটিং করার সুযোগ ছিলনা। মোখতার আহমদ সেই সময় নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আমার বিরুদ্ধেও ঐ সময় একাধিক মামলার হুলিয়া। আমি গোপনে মোখতার ভাইয়ের ঘাটফরহাদবেগস্থ বাসায় গিয়ে মাঝেমধ্যে দেখা করতাম। ২০০২ সালে জুলাই মাসের মাঝামাঝি তিনি আমাকে তাঁর বাসায় দেখা করতে খবর দিলে পরের দিন সন্ধ্যায় আমি সেখানে যাই। সেখানে আগে থেকেই বখতেয়ার নুর সিদ্দিকী, আব্দুল্লাহ কবির লিটন, আবু সৈয়দ সহ আরো অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাঁশখালীতে জাতীয় শোক দিবসের কর্মসূচি পালন করার লক্ষ্যে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একটি শোক কমিটি গঠিত হয়। ১৮ জুলাই বিকালে আমার চাঁদপুরস্থ বাড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সম্পাদক, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক করে বর্ধিত সভা হলে সেই সভায় মোখতার আহমদকে আহ্বায়ক ও আমাকে সদস্য সচিব করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট শোক কমিটি গঠিত হয়। মোখতার ভাই চট্টগ্রাম শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদ, বৈশাখী মেলা, একুশে মেলা, চট্টগ্রাম স্বাংস্কৃতিক সমন্বয় পরিষদের উপদেষ্টা এবং স্বাধীনতা মেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০০৭ সালে ২রা আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সাবেক এম.এন.এ ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম আবু ছালেহ্‌ এর সভাপতিত্বে মোখতার ভাইয়ের শোকসভা পালিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এম.. মান্নান, বিশেষ অতিথি আতাউর রহমান খান কায়সার, বখতেয়ার নূর সিদ্দিকীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। এরপর মোখতার ভাইয়ের স্মরণে দীর্ঘ ১০ বছর কোন সভা অনুষ্ঠিত হয়নি। যা রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের জন্য দুঃখজনক ঘটনা।

২০১৬ সালের মাঝামাঝি উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার ফোরাম চট্টগ্রাম উত্তরের সভাপতি ও মালয়েশিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ড. মাহমুদ হাসানকে সভাপতি, আমাকে সাধারণ সম্পাদক, মোখতার আহমদের বড় ভাইয়ের ছেলে বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক নজরুল ইসলাম মোস্তাফিজকে সমন্বয়কারী করে ২১ সদস্যের মোখতার আহমদ নাগরিক স্মরণ সভা কমিটি গঠিত হয়। ঐ বছর ২৯ অক্টোবর বিকাল বেলা দোস্ত বিল্ডিং চত্বরে মোখতার ভাইয়ের ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাঁশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী এম.পি, প্রধান বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্মসম্পাদক বীর মুক্তযোদ্ধা বর্তমান সিটি মেয়র এম. রেজাউল করিম চৌধুরী। আমার জানামতে এটাই ছিল তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর পরে একমাত্র স্মরণ সভা। সকল লোভলালসার উর্ধ্বে ছিলেন তিনি। রাজনীতি যে মাটি ও মানুষের জন্য এবং দেশের জন্য মোখতার আহমদ তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এখন রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়নের প্রতিযোগিতা সবার উদ্দেশ্য হল নেতা হয়ে আমি কি পেলাম! ত্যাগ আদর্শ নীতি এগুলোর আজ কোনও মূল্য নেই। ধনীরাই এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এক সময় দেশে রাজনীতিবিদরাই দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করতেন আর এখন তার বিপরীত। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা মাঠের চেয়ে ব্যানার ও ফেসবুকে বেশি। আজকের দিনের বাস্তবতা হচ্ছে যে যত বড় ধনী সে তত বড় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী নেতা। এরশাদ সরকারের আমলে এম.পি থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম শহরে কোথাও তাঁর একখণ্ড জমি নেই। পৈতৃক ভিটেমাটি সবকিছু নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলে ঐ সময় অবৈধভাবে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু অবৈধ অর্জন, অর্থের মোহ, লোভ লালসা কোনটাই তাকে নীতি, আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। তিনি আমাদের মাঝে আর কোনদিন ফিরে আসবেন না। তার নীতি আদর্শ আগামী প্রজন্মের জন্য দিক নির্দেশনা হয়ে থাকবে। আসুন আমরা সকলে এই ক্ষণজন্মা বীর পুরুষের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন।

লেখক : রাজনৈতিক নেতা, সমাজব্রতী

পূর্ববর্তী নিবন্ধমুজিব জাতির রূপকার
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে