১লা জুলাই, ১৯৭৪ সাল, চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত আস্থাভাজন সংগ্রামী সহযোদ্ধা ঢাকার পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না… রাজেউন)। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি সংগ্রামমুখর অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। অধিকার বঞ্চিত ও গরীব মেহনতি মানুষের অকত্রিম বন্ধু বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর আর কখনো শোনা যাবে না। শোকে মুহ্যমান জনতা নতুন কোন অভিভাবকের অপেক্ষায়. কখন আবার পাব এরকম একজন সুহৃদ, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন প্রায় পাঁচ দশক পূর্বে। এখনো শূন্যস্থান পূরণ হয়নি। প্রিয় নেতার অতি আদুরে স্নেহধন্য এক সংগ্রামী যুবকের (এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী) আবির্ভাব হয়েছিল পুণ্য ভূমি সংগ্রামের সূতিকাগার চট্টগ্রামে। নেতার আদর্শে উজ্জীবিত এ যুবক মহীরূহে পরিণত হতে না পারলেও অনেকখানি সফলতা অর্জন করেছিল স্বীয় কর্মোদ্যেমের মাধ্যমে, তাঁকে ও মানুষ শ্রদ্ধা করবে বহুদিন। এরকম কোনো সংগ্রামী কর্মীর এখনও দেখা মিলছেনা। দেশবাসী ভবিষ্যতে আরেকজন অকুতোভয় সৈনিকের অপেক্ষায় রইল।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ‘রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে জানা যায় ১৯৪৩ সাল হতে জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম এ আজিজ’র সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় ও বন্ধুত্ব। ঐ সময় জহুর আহমদ চৌধুরী কলকাতার খিদিরপুর ডক ইয়ার্ডের শ্রমিকদের নিয়ে শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ইসলামিয়া কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। চট্টগ্রামেও জহুর আহমদ চৌধুরীর ঘোড়ার গাড়ি চালকদের নিয়ে সর্বপ্রথম শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলেন প্রায় একই সময়ে। এ জন্য তাঁকে চট্টগ্রামের শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার পথিকৃৎ বলা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লাভের পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে দমন করার কূটকৌশল শুরু করেন। তখন মাওলানা ভাসানী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসন্ন বিপদ লক্ষ করে অন্যান্যদের ঐক্যবদ্ধ করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজগার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ (আওয়ামীলীগ) নামে সর্বপ্রথম বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠান করেন। কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিব সংগঠনকে তৃণমুল পর্যায়ে সংগঠিত করার লক্ষ্যে, জেলা কমিটি গঠন করতে ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে চট্টগ্রাম আসেন। পূর্ব পরিচিত সংগ্রামী সহযোদ্ধা জহুর-আজিজের সহযোগিতায় আমির হোসেন দোভাষ ও জহুর আহমদ চৌধুরীকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করে সিটি আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজাফফর আহমদকে সভাপতি ও এম এ আজিজকে সাধারণ সম্পাদক করে, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ কমিটি গঠন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কন্টকাকীর্ণ পিচ্ছিল রাজপথে চলা শুরু করেন নেতা জহুর ও আজিজ। জেল জুলুম নির্যাতন ভয়ভীতি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেন সংগ্রামী নেতা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে আহবায়ক কমিটির সদস্য হন। ১৯৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে মুসলিম লীগ নেতা ধনকুবের শেখ রফিকউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। এ বিজয়ের মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণিত হল ‘মানুষ মানুষের জন্য’। অধিকার বঞ্চিত শোষিত মানুষের জন্য সংগ্রাম কখনো বৃথা যায় না। একদিন না একদিন এর প্রতিদান পাওয়া যাবেই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খানের মার্শাল ল ও আয়ুব বিরোধী আন্দোল করতে গিয়ে কারা বরণ করেন। ১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা আন্দোলন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান ৭১’র অসহযোগ আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়াসহ সর্বপ্রকার, আন্দোলন সংগ্রামে পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী।
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ লালদীঘি ময়দানে ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রস্তাবের পক্ষে দেশের সর্বপ্রথম জনসভা তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু এ জন সভা হতে জনতার উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম ৬ দফার ব্যাখ্যাসহ বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট প্রেরিত হয়েছিল চট্টগ্রাম রেডিও হতে প্রচারের উদ্দেশ্যে। ২৬ মার্চ সকালে আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বাসভবন জুপিটার হাউসের এক অনির্ধারিত বৈঠকে নব নির্বাচিত সংসদ সদস্যবৃন্দ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্তে জহুর আহমদ চৌধুরীর অসুস্থতা হেতু চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বেলা আড়াইটার সময় কালুরঘাট রেডিও স্টেশন সম্প্রচার কেন্দ্র হতে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন জার্নাল কাউন্সিল-০২’র (আগরতলার) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চেয়ারম্যান, জোনাল কাউন্সিল০১) সহ আমরা অনেকেই আগরতলার এল পি সি সি রেস্ট হাউসে অবস্থান করতাম, জোনাল কাউন্সিল গঠিত হবার (জুলাই’৭১) পূর্ব পর্যন্ত আগরতলা বাংলাদেশ সরকারের আঞ্চলিক কার্যালয়ে স্টোর অফিসার’র দায়িত্ব পালনকালে আমি নেতার সাথে রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতায় তাঁর অগাধ জ্ঞানের পরিচয় পাই। নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের জন্য তার অকুন্ঠ দরদ ছিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকার বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা তিনিই উড্ডীন করেছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ এবং পরবর্তীতে (আমৃত্যু) শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। জাতিরজনক ও তাঁর মধ্যকার গভীর সম্পর্ক ছিল। পিজি হাসপাতালে অসুস্থ থাকালীন চট্টগ্রামের কয়েকজন নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রাম থেকে আরেকজন মন্ত্রী করার অনুরোধ করলে বঙ্গবন্ধু ভীষণ রাগান্বিত হয়ে বলেন “জহুর যতক্ষণ জীবিত আছে ততক্ষণ মন্ত্রী থাকবে- হাসপাতালে বা বাড়িতে” মৃত্যুর খবর পেয়ে বলেছিলেন: আজিজের মৃত্যুতে আমার ডান হাত হারিয়েছি, আর জহুরের ইন্তেকালে আমার বাম হাতটাও হারালাম। মরহুমের সুযোগ্য পুত্র মাহতাবউদ্দিন চৌধুরী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে থেকে পিতার আদর্শে এগিয়ে যাচ্ছেন সাহসের সাথে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক।