কোনো এক স্নিগ্ধ সকালে চট্টগ্রামের জামালখানের অনিন্দ্য সুন্দর রেস্টুরেন্ট বীর চট্টলার দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন দক্ষিণা বাতাস ভেসে আসছিল আর সূর্য ধীরগতিতে আকাশে উঠে আসছিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে একটি ছোট্ট পুস্তক বাক্স ছিল, যেখানে নানা ধরনের পুরনো বই সাজানো ছিল। আমি কিছুটা অবাক হই দেখে, বইগুলোর মধ্যে বেশ কিছু পছন্দের নামও ছিল, এই বইয়ের অনেকগুলো আমি কয়েক বছর আগে পড়েছিলাম। সেগুলো একেবারেই নতুন সংস্করণ ছিল না, বরং বইয়ের কভারগুলো এমনই পুরনো ছিল যে, আমি সেই সময়ের পড়ার স্মৃতির মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম আর আমাকে খুব একাত্ম অনুভব করিয়ে দিলো।
অন্দরমহলে প্রবেশ করে আরও দেখতে পেলাম চট্টগ্রামে নিজস্ব অনেক ঐতিহ্যের সমাহার, পুরনো তৈজসপত্র, আশি–নব্বই দশকের প্রচলিত অনেক ব্যবহার্য জিনিসপত্র, যা বর্তমান সময় ও সমাজে এখন হারিয়ে গেছে।
এখানে মানুষজন শান্তভাবে চা–কফি পান করছে, কেউ কেউ গল্প করছে, কেউ কেউ বই পড়ছে। আমার পছন্দের একটি শূন্য টেবিল দেখে আমি বসে পড়লাম। অদূরে, একটি বাচ্চা ছেলে কফি হাতে পত্রিকা পড়ছিল। কফির গরম সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো পরিবেশে। আমি আমার কফি অর্ডার করার পর, সেলফ সার্ভিস কাউন্টারের দিকে যেতে যেতে একজন মধ্যবয়সী মহিলার দিকে নজর পড়ল।
তিনি কিছুটা ভাবনামগ্ন হয়েছিলেন, তবে আমার উপস্থিতি উপলব্ধি করে তিনি হাসি দিয়ে আমাকে অভিবাদন জানালেন। আমি তাকে চিনি না, তবে তার মুখাবয়বটি কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছিল। আমাকে দেখে তিনি একটু এগিয়ে এলেন এবং বললেন, ‘আপনি কি নতুন অতিথি? আমি এখানে প্রায়ই আসি। বীর চট্টলাটি খুবই শান্তিপূর্ণ, তাই এখানে সময় কাটাতে ভালো লাগে।’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘হ্যাঁ, আমি কিছু দিন আগে এখানে আসতে শুরু করেছি, তবে একেবারে নিয়মিত নয়।’
তিনি আমাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রেখে বললেন, ‘আপনি জানেন কি, এই কফি শপে আসার আগে আমি ঢাকায় থাকতাম। সেখানে আমার জীবন কাটিয়েছি অনেক বছর। ঢাকা, আপনি জানেন তো, কতটা জাদুকরী শহর। তবে কিছুদিন আগে আমি চট্টগ্রাম চলে আসি। এখানে এক অদ্ভুত শান্তি রয়েছে। খুব অদ্ভুত, সত্যি।
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখলাম। ‘ঢাকা? আপনি কি ঢাকায় বসবাস করেছিলেন?’
তিনি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, তবে ঢাকায় শুধু বসবাস ছিল না, আমি সেখানে একটা বইয়ের দোকানও চালাতাম। তবে, সেই সময়টা খুব একটা সুখকর ছিল না। ঢাকার এক কোণায় বসে থাকার চেয়ে, এখানে, চট্টগ্রামের এই শান্ত পরিবেশে বসে চা–কপি পান করা অনেক বেশি ভালো লাগে।’
আমি কৌতূহলী হয়ে শুনছিলাম। ‘তাহলে, আপনার ঢাকায় থাকার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন। কিছু বিশেষ স্মৃতি আছে কি?’
তিনি কিছু সময় চুপচাপ রইলেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, বিশেষ স্মৃতির অভাব নেই। একবার ঢাকার একটি ছোট রেস্টুরেন্টে বসেছিলাম, যেখানে আমি প্রতিদিন বিকেলে এসে কফি খেতাম। সেই রেস্টুরেন্টের একজন ওয়েটার ছিল, যার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। তার নাম ছিল রফিক। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছিল, যেন আমরা একে অপরকে বহু বছর ধরে চিনি। সে একজন ভদ্রলোক ছিল, কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। একদিন সে আমাকে বলল, ‘আপনি কি কখনও জানতেন, বাংলা খাদ্য–সংস্কৃতির অনেক দিক মোগল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল?’ আমি শুধু তাকিয়ে ছিলাম, তার কথাগুলো আমাকে গভীরভাবে ভাবাতে শুরু করেছিল।
এভাবে কথা বলতে বলতে, তিনি আমার কাছে একেবারে নিজের গল্প শেয়ার করতে লাগলেন। তার জীবন কাহিনি এমন এক অদ্ভুত মোড় নিল যে, আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না কখন সময় চলে গেছে। তার ছোট্ট দোকানের অভিজ্ঞতা, ঢাকার নিঃসঙ্গতা, আর চট্টগ্রামে আসার পরের গল্পগুলো আমাকে এক নতুন দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখতে শিখিয়েছিল।
কিছু সময় পর, তিনি আবার বললেন, ‘আমি জানি, আপনি হয়তো অনেক কিছু জানতে চাইছেন। তবে একবার ভেবেছিলাম, কেন রফিকের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পরেও আমার সেই জীবনটা কখনও শেষ হয়নি। তবে, চট্টগ্রামে যখন এলাম, আমি বুঝতে পারলাম, এখানে আসল শান্তি। চট্টগ্রামের সাথে স্নিগ্ধতা মিলিয়ে, এক নতুন জীবন শুরু হয়েছে।
আমি কিছুটা চুপচাপ বসে রইলাম। তার জীবনের এত গভীরতা ছিল, এত মিষ্টি কিন্তু একই সাথে এক গভীর দুঃখের স্পর্শ ছিল। একেবারে সাধারণ একজন মানুষ যে বইয়ের দোকান চালাতো, সে কীভাবে তার জীবনকে নতুন রূপ দিলো, আমি ভাবতে লাগলাম।
তারপর, তিনি কিছু সময়ের জন্য আবার চুপ থাকলেন। এক মুহূর্তের জন্য শান্তিতে তিনি আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর বললেন, ‘জীবন শুধু এক সাঁকো, কখনও খোলামেলা, কখনও বন্ধ। তবে, তাতে আমি যা খুঁজে পেয়েছি, তা হলো শান্তি। আমি জানি, আমি যা পেয়েছি, তা অন্য কেউ পায়নি। আর সেই শান্তি আমি এই বীর চট্টলায় পেয়েছি।’
আমার কফি শেষ হতে চলছিল, কিন্তু আমি তার কথাগুলো শোনার মধ্যে যেন এক নতুন পৃথিবী খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আপনার জীবনটা সত্যিই এক অদ্ভুত গল্প। আমি জানি, একদিন হয়তো আমারও এমন কিছু অনুভূতি হবে।’
তিনি মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ‘অবশ্যই হবে। তবে মনে রাখবেন, জীবনের আসল গল্প তা নয় যা আমরা দেখি, বরং তা হলো যা আমরা অনুভব করি। আর অনুভূতির গহীনে অনেক কিছু থাকে।’
এটা ছিল চট্টগ্রামের সেই শান্ত ‘বীর চট্টলা’র একটি অদ্ভুত সাক্ষাৎকার, যেটি আমার চিন্তাভাবনাকে নতুন দৃষ্টিতে নিয়ে গিয়েছিল।