শিক্ষক বলেছিলেন, তুমি বীরাঙ্গনার মতো। সৎ, সাহসী, তোমাকে কেউ পরাভূত করতে পারবে না। থেমো না। পড়শি চাচীমা তেড়ে এসে কপাল ছুঁয়ে বললেন, ছি ছি! জানিস নাকি কারা হয় বীরাঙ্গনা? কপালে বড় টিপ, যাদের শরীর ছুঁয়েছে হাজারো দানব। ছিঁড়ে খেয়েছে শকুনের দল। তুই বীরাঙ্গনা হবি কেন? তুই তো টোটাম (পবিত্র, সুন্দর)। তুই আমাদের রাজকন্যা।
এরপর বেড়ে উঠেছি স্বর্ণলতার মতো। জড়িয়ে আষ্টে–পিষ্ঠে, আমার মাকে। ছায়ার আঁচলে বাঁধেননি বলেই মার খেয়েছি, পড়েছি, চড়েছি রাস্তার মোড়ে মোড়ে। বাস, বেবি টেক্সি, রিকসা, পথের প্রত্যেক প্রান্তেই অসুরের হাত টাওয়ারের ন্যায় নজরে রেখেছে, একটু বেঁকে গেলেই এখন ঝাঁপিয়ে পড়বে শরীরে। ফলে সতর্কতার বাপকেও ছাড়িনি, ভেবেছি আমিই বীরাঙ্গনা। যার শক্ত মনকে কেউ ছিঁড়ে খাবে না, কেউ বলবে না তুই তো বাজারের তরিতরকারি।
‘গেরিলা’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আগুনের ফুলকি’, ‘জীবন থেকে নেওয়া’ এমন সব সিনেমা সাহস জুগিয়েছে, নারীর অবয়বকে যে গতিতে পিষে রাখতে চেয়েছিলো, তারচেয়ে বহুদূর আমাদের মা–বোনেরা। সকলেই মুক্তিযোদ্ধা।
বীর আর অঙ্গনার সন্ধিতে বীরাঙ্গনা। বাংলায় অঙ্গনা বলতে সুন্দরী দেহের নারীকে বোঝায়। কিন্তু যে নারী নির্ভীক তার সৌন্দর্য তো প্রতিরোধে। ফলে বীরাঙ্গনা তো সাহসের মূর্ত প্রতীক। শব্দের রাজনীতিতে লোকে কেন পুরুষের ন্যায় বীরত্বকে মাপেন তার গল্প এতটাই পঁচে গলে গেছে যে, এ দুর্গন্ধ আর কেইবা ঘাটতে চাইবে। কিন্তু আমাদের বাংলার, বাংলাদেশের বীরাঙ্গনা কি শুধুই শব্দের খেলা? এর ইতিহাস তো বিশাল গৌরবের।
স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সরকার মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হওয়া নারীদের তাদের আত্মত্যাগের সম্মানার্থে বীরাঙ্গনা উপাধি দেয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বাংলার মা–বোনেদের ক্ষত এখনো শুকায়নি। তারামন বিবি, ডা. সিতারা বেগম, ফিরোজা বেগম, রমা চৌধুরী, ডলি চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীসহ এমন অসংখ্য নাম আমাদের জানা। যদিও চারশতের বেশি বীরাঙ্গনা এখনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বাইরে।
একটি দেশের জন্মলগ্নের রাজসাক্ষী ও যোদ্ধারা কি কখনো চাইবেন নিজেদের বীরত্বের গল্পকে লুকিয়ে রাখতে?
‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’, ‘বীরাঙ্গনা সমগ্র’, ’৭১–এ আমার মা’, ‘নিন্দিত নন্দন’ এমন উল্লেখযোগ্য কিছু বইতে বীরাঙ্গনাদের হার না মানা গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের কথা। কিন্তু এর বাইরেও কিছু অজানা গল্প থাকে। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যারা নিজেদের যুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহে রাখে না। সত্তর বছরে জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের প্রামাণ্য দলিল তারা সংরক্ষণ করেছে। হয়েছে সিনেমা, সাহিত্য। তারা পৃথিবীকে বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে ফ্যাসিস্টদের আচরণ, কর্ম, নির্মম বাস্তবতা। আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইরান কেউই তাদের ইতিহাসকে অশ্রদ্ধা করেনি কিন্তু বাংলার কতজন জানেন বীরাঙ্গনাদের গল্প? এমন অনেক বীরাঙ্গনা আছেন যারা এখনো বলতে ভয় পান নিজেদের আত্মত্যাগের কথা।
মাত্র দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল ফিরোজা বেগমের। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার। গুটি পায়ে হেঁটে বেড়ানো ছয় মাসের সন্তানকে নিয়ে কতশত আহ্লাদ মায়ের। কিন্তু দেশে শুরু হলো যুদ্ধ, ভয়াবহ যুদ্ধ। যেখানে যাকে পাচ্ছে তাকেই নির্যাতন, হত্যা করা হচ্ছে। কালেমার বিনিময়ে গুটি কয়েক রক্ষা পেলেও বাঙাল জানলেই মেরে ফেলার ভয়াবহ দৃশ্য। আগুন আসে ফিরোজা বেগমের ঘরেও। কোনো মতে ছেলেকে নিয়ে ঝোপঝাড়ে গেলেও কাল হয় এই ফুটফুটে সন্তানের কান্না। পাকিস্তানি বাহিনী পরক্ষণেই বুক চিড়ে দুই ফালি করে তাকে। বুকের ওপর পা মাড়িয়ে নেমে আসে নির্যাতন। অজ্ঞান ফিরোজা বেগমকে নেওয়া হয় ক্যাম্পে। সেখানেই ছিল আরো নারী, শিশু, বৃদ্ধা। কেউই রেহাই পায়নি। যশোরের বাগআঁচড়া গ্রামের সে–ক্যাম্পে চলে পাশবিক নির্যাতন। চুল কেটে দেয়। কেউ যেন ফাঁসি না খায় তাই খুলে রাখা হয় সকলের গায়ের কাপড়। পানির বদলে মিলতো নিজেদেরই প্রস্রাব। অমানুষ পাকিস্তানী আর্মি বাহিনী একের পর এক নির্যাতন চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে হেমায়েত মুক্তিবাহিনী সেই ক্যাম্পে আক্রমণ করে ফিরোজাসহ অসংখ্য বীরাঙ্গনাদের উদ্ধার করেন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন ফিরোজা। তাকে আরেক মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফাতেমা আলী চিকিৎসা দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু স্বাধীন দেশে বীরাঙ্গনার পরিচয় দিতে লজ্জা পান ফিরোজা বেগম। লোকে ছি ছি করে। লুকিয়ে মেয়েকে দিয়েছেন বিয়ে কিন্তু তার তিন সন্তান রেখে স্বামী চলে যান। কারণ একটাই ফিরোজা বীরাঙ্গনা। তবে কি বাংলার বীরাঙ্গনারা অশুচ? বীরাঙ্গনা শব্দকে কেউ কেন অনুচ্চার্য রাখতে চায়? কারা চায়?
বাংলার দমদমে বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া বেশ কষ্টের। নারী হলে তা অসম্ভব প্রায়। কিন্তু যে দেশের নাম নিয়ে এত বেচাকেনা, অহংকার, নাগরিকের সুবিধা ভোগ, জি আই পণ্যের জন্য আহাজারি, মাটির গন্ধ নেওয়া সে দেশের যুদ্ধের ইতিহাস এতই অশুচ কেন, কেন জয় বাংলাতে ভয়, কেন বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি দিতে এত দ্বিধা। এই লজ্জা, এই ছি ছি কি যোদ্ধাদের নয়? কাদের জন্য তারা তবে স্বাধীন করলো এই দেশ।
নারী ঘরে থাকলে পাবে সম্মান, কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা হবে, স্বামী সন্তানের সেবায় পাবে ভাতা, ভোটে মিলবে জান্নাতের টিকেট, জাতীয় সঙ্গীত বেধর্মী গান, রোকেয়া একটি গালি…নারী তোমার হিজাব কই? এ সবই কি তবে স্বাধীন দেশের স্বাধীন সূচক? যে দেশের মাটিতে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য বীরাঙ্গনার রক্ত, মাথার খুলি, মুক্তিযোদ্ধার বলিদান সে মাটি কি এত অন্যায়ের বোঝা সহ্য করতে পারবে? আকাশ ভেঙ্গে মাটিতে লুটাবে কবে ইকারাস। ঈশ্বর কেন আমাদের মেঘদূত বানাননি তবে?
বাংলার অসংখ্য বীরাঙ্গনার মুখের ভাষ্যে অন্তত একবার উঠে এসেছে তাদেরকে অশুচ ভাবা হয়েছে। কারণ একটাই। তাদেরকে পাকিস্তানি বাহিনী দমাতে পারেনি। নারীর সম্ভ্রম তার যোনীর বাইরে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার সোচ্চার প্রতিরোধ বাংলার পুরুষকে ভীত করে তুলেছে। তাদের প্রতিনিয়ত দমিয়ে রাখার সীমানাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দেশের স্বাধীনতার সম্মান বাগিয়ে নেওয়ার লোভ কেউ ছাড়তে পারেনি। নারীকে কেবল অশুচ প্রমাণ করলেই তার সমস্ত ত্যাগকে অস্বীকার করা যায়। ফলে বীরাঙ্গনা অনুচ্চার্য।
বাংলার পরাজিত শত্রুর কাছে বীরাঙ্গনা ভয়ের নাম, অশুচ। আপনি বীরাঙ্গনাকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ বাংলার স্বাধীনতাকে জয়ী করা। বাংলার শত্রুর কাছে ফলে বীরাঙ্গনা একটি রাজনৈতিক দাবার চাল। ধর্মপ্রাণ ভাইয়ের কাছে নামাজের চেয়ে যেমন মাজহাব বড় তেমনই দেশের চেয়ে দল বড়। ফলে বীরাঙ্গনা এখন অশুচ।
কিন্তু আমরা জানি, বাংলার মায়েরা বোনেরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। যতবার দেশের উপর হায়নার থাবা পড়েছে ততবারই তারা এগিয়ে এসেছে। নিজের তরবারিকে এগিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ করেছে, দেশ স্বাধীন করেছে। ভোট ব্যাংকে তার জায়গা শুধু সংখ্যায়, সংসদে শুধু নির্ধারিত আসনের নিশ্চয়তা আর যুদ্ধ শেষে বাড়িতে থাকার ভাতা তাকে বিচলিত করে না। ফলে বীরাঙ্গনা একটি প্রতিরোধের সুর, সাহসের প্রতীক, দেশের সার্বভৌমত্বের সূচক। দলে দলে নারী চিনে রাখে তার দেশের শত্রুকে, চিনে রাখে তার খুনীকে। বাংলার জয়কে জিইয়ে রাখে।












