বিস্মৃতির প্রলম্বিত ছায়ার নিচে

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী

কানাই দাশ | সোমবার , ৩ জানুয়ারি, ২০২২ at ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাথেই এক ব্যাপক জনযুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তীব্র জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষের দীর্ঘ ২৩ বছরের নানামাত্রিক লড়াইয়ের চূড়ান্ত পরিণতি ’৭১-এর উত্তাল গণসংগ্রাম ও সশস্ত্রযুদ্ধ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সেই ২৩ বছরের নিপীড়নের ইতিহাস বিক্ষুব্ধ জাতির মর্মবেদনা ভাষা দিলেন এই বলে যে “২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।” ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দি কমিউনিস্টদের উপর সরাসরি গুলি চালিয়ে সাতজন কমিউনিস্টকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে যে গণহত্যা এদেশে পাকিস্তানিরা শুরু করেছিল ৩০ লক্ষ শহিদের নির্মম গণহত্যা দিয়ে তা শেষ হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির এই দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামে অংশ নিয়েছে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট কমিউনিস্টসহ সমাজের নানা পেশা ও শ্রেণির মানুষ। ’৭১-র অসম সশস্ত্র লড়াইয়ে এ দেশের পাশে দাঁড়ায় ভারত, সোভিয়েত রাশিয়াসহ গণতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট বিশ্ব। ’৭৫ পরবর্তী শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে ও ইতিহাসের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়কে বেমালুম অস্বীকার করে এক বালখিল্য কুরুচিপূর্ণ বিকৃতি ও বিস্মৃতির উন্মাদনায় মেতে ওঠে। অবশেষে মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের মতো ইতিহাসের নায়ক হিসেবে বেরিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধু।
আজ বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের শাসনামলে এসেও ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর, উদ্বেলিত ’৭১ বা ’৭২-এর বাংলাদেশকে বাস্তবে কল্পনা করতে পারি না। গণতন্ত্রহীনতা ধর্মান্ধতা, নব্যবর্গীর লুটপাটে বিধ্বস্ত এ যেন এক বিকৃত অচেনা, বাংলাদেশ। অনেকের মুখে আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্পাঠ বা নতুন এক ন্যারেটিভ শোনা যাচ্ছে। সেই ন্যারেটিভে নয় মাসের সামষ্টিক উদ্যোগের উল্লেখ নেই, নেই ‘others’ দের অস্তিত্ব। সামরিক শাসকদের প্রতিহিংসা ও মূঢ়তার বিপরীতে অন্য এক ধরনের বিকৃতির ও বিস্মৃতির চর্চা চলেছে। দেখে শুনে এলিয়টের সেই কথাই মনে পড়ছে “After such knowledge what forgiveness! Think now,/History has many cunning passages, contrived corridors/And issues, deceives with whispering ambitions. ১৯৭৫-এর পরে এদেশের ইতিহাস রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের cunning passage-এ ঢুকে গেছে, আর ধূর্ত রাজনৈতিক নেতাদের whispering ambition এবং চক্রান্তে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ক্রমে পরিণত হয়েছে এক দুর্বৃত্তায়িত রাষ্ট্রে- নিউ লিবারেলিজম নামক এক লুটেরা বৈশ্বিক ব্যবস্থার কল্যাণে। কিন্তু আপাত স্থায়ী এই লুটেরা ব্যবস্থা মানুষের দুঃসহ প্রবঞ্চিত জীবনের বাস্তবতার নিত্য দ্বন্দ্বে একদিন ভেঙে পড়বেই। শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতান্ধতা ও মৌলবাদী মতান্ধতা বাস্তবের কষাঘাতে পরিবর্তন হতে বাধ্য। কেননা মানুষকে এগুতে হবে অস্তিত্বের প্রয়োজনে। ইতিহাস যেমন তাকে তৈরি করছে সেও তৈরি করছে ইতিহাস। কখনো ডানে কখনো বামে ছন্দ বাজবে কালের মন্দিরায়, সেই ছন্দের সঙ্গে জনজীবনের তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টাই হলো ইতিহাস। সব ধরনের বিমূর্ত আবেগ আর অন্ধভক্তি ইতিহাসে টিকে না। শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনে ইতিহাসের এই গতি প্রগতিতে রূপ নেয়। রাষ্ট্রনৈতিক এই পরিবর্তনে বা বিপ্লবে ব্যক্তির ভূমিকা শেষ বিচারে গৌন এ অর্থে যে ব্যক্তির ক্যারিমশা যতই প্রবল হোক প্রাকৃতিক কারণেই ব্যক্তি সামর্থ্য সীমিত। নেতৃত্বের সামষ্টিক প্রচেষ্টা, জনজীবনের মরণজয়ী উদ্যোগ সেই পরিবর্তনকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলে। ফরাসী বিপ্লব কোনো এক ব্যক্তির একদিনের শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টায় হয়নি বরং সামন্তবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কয়েক দফায় এ বিপ্লব চলতে থাকে। রবসপিয়ারকে কিছুদিনের জন্য নেতৃত্ব দিতে দেখা গেলেও তাঁকে ফরাসী বিপ্লবের একক নেতা বলা হয় না।
দুনিয়া কাঁপানো রুশ বিপ্লব লেনিনের একক নেতৃত্ব স্বীকার করে না। যদিও রাশিয়ার বৈপ্লবিক সংগ্রাম লেনিনের ভাবনায় প্রভাবিত ও পরিচালিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত একক নেতৃত্ব কোথাও কখনো পরিলক্ষিত হয়নি। হয়তো আন্দোলনের এক পর্যায়ে ক্যারিশমেটিক কোনো নেতার বিমূর্ত জাদুকরী প্রভাব লক্ষ মানুষকে উদ্বেলিত করেছে কিন্তু বিজয় লাভে কাজ করেছে সামষ্টিক ও যৌথ নেতৃত্ব। চীনের বিপ্লবে মাওয়ের সহযোগী হিসাবে লিউ শাও চি ও চৌ এন লাই প্রমুখের প্রধান ভূমিকা ছিল। কিউবার বিপ্লব তো ফিদেল আর চের এক যুগলবন্দি কাজ, ভারতে গাঁধীর সাথে অনিবার্যভাবে এসে যায় নেহেরু, পটেল, আজাদের নাম। আমাদের দেশে ’৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে বিশেষত ৬ দফা পেশের পরে অনেকেই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে চলে যান কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দিন মিলে গড়ে উঠে এক অসাধারণ রাজনৈতিক জুটি। বঙ্গবন্ধুর অসীম সাহস, অনাবিল হৃদয়াবেগ, তাজউদ্দিনের প্রজ্ঞা, মেধা আর উভয় নেতার অতুলনীয় সততা ও নৈতিকতা মুক্তির সংগ্রামকে অপ্রতিহত গতিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে রূপদান করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তাজউদ্দিন নিজ সিদ্ধান্তে অটল থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা তথা বঙ্গবন্ধুকে প্রধান করে প্রবাসী সরকার গঠনের উদ্যোগ নেন। উপায়ান্তর না দেখে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে সভাপতির অনুপস্থিতিতে দলের সম্পাদক হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। বঙ্গবন্ধুর চাইতেও ভুট্টো-ইয়াহিয়ার বয়ানে তাজউদ্দিনকে অধিক বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সমস্ত প্রতিকূলতা ও যড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে তাজউদ্দিন দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষে এগিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু একদিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চিরবৈরী ‘সহকর্মী’ মোশতাক, মিজান চৌধুরী প্রমুখ দক্ষিণপন্থীদের প্রত্যাশিত বিরোধিতা অন্যদিকে শেখ মণি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রায় পুরো ছাত্র ও যুবনেতৃত্বের অপ্রত্যাশিত বিদ্রোহ তাজউদ্দিনকে বিপদে ফেলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নিয়ত তিনি অসহায় যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে থাকেন। হুমকির মুখে পড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সাফল্য। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের দৃঢ় সমর্থন, সোভিয়েত ও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের আস্থা, সে সময়ে শক্তিশালী ন্যাপ-সিপিবি’র সক্রিয় সহযোগিতা ছিল তাজউদ্দিনের সাফল্য তথা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মূল শক্তি। নয় মাস ধরে অতি সাধারণ ও পারিবারিক সাহচর্য বিহীন এক সন্তের মতো যাপিত জীবন, দৃঢ় প্রত্যয় ও আশাবাদে উজ্জীবিত ফ্রন্টে ফ্রন্টে ঘুরে বেড়ানো তাজউদ্দিন ছিলেন বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রামের এক অকুতোভয় নায়ক। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনকে ত্বরান্বিত করে। কোনো অবস্থাতেই তিনি নিজের ও দেশের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেননি। কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্নের স্বাধীন দেশে ’৭২ সাল থেকেই তিনি অবহেলিত ও উপেক্ষিত হতে থাকেন। তারপরও ১৯৭৫-এর মধ্য জুলাই এক রাতে অযাচিতভাবে ৩২ নং-এ গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সাবধানে চলার পরামর্শ দিয়ে এসেছিলেন।
বাঙালির এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল সেই সময়ের শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র, মাওবাদী চীন এবং বলতে গেলে পুরো মুসলিম বিশ্ব। পাকিস্তানের পক্ষের এই বিশাল শক্তিকে মোকাবিলার একক ক্ষমতা ভারতের ছিল না। সেদিনের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় সমর্থন হয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের জন্য একমাত্র গ্যারান্টি। গণহত্যার বিরোধিতা করলেও বাংলাদেশকে সক্রিয় সমর্থনের প্রশ্নে ভূ-রাজনৈতিক কারণে প্রাথমিকভাবে দ্বিধায় ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার। সেই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে ন্যাপ ও সিপিবি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তা নিয়ে সোভিয়েত পার্টি ও সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে বাঙালির সশস্ত্র যুদ্ধ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। অধ্যাপক মোজাফফর ও সিপিবি নেতা মণি-সিং-এর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় সেদিন সোভিয়েত সমর্থন নিশ্চিত হয় এবং পরবর্তীতে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীচুক্তির স্বাক্ষরের পথ সুগম হয়। এই চুক্তি ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট। এতে ভড়কে যায় চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত রাশিয়ার আশ্বাসে ভারত পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা ভুলে যাই আমাদের জন্য রাশিয়ার বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি নেয়ার ইতিহাস, ভুলে যাই বিশ হাজর ভারতীয় সৈন্যের জীবন দানের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জটিল বৈশ্বিক রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে সার্বিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর পরেই মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিন, অধ্যাপক মোজাফফর ও কমরেড মণি সিং-এর অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ তিন জনকে যথোপযুক্ত মর্যাদায় স্মরণ করার নৈতিক দায় থেকে যায় জাতি ও রাষ্ট্রের। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৫ বছর পরে ২০১৫ সালে মোজাফফর আহমদকে আওয়ামী লীগ সরকার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলে তিনি স্বভাবসুলভ পরিহাস ছলে তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত করেন আর আমাদের নষ্ট রাজনীতির কপট চাতুর্যকে চপেটাঘাত করেন। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রবাসী সরকারের প্রধান, আত্মনিবেদিত রাজনীতির মূর্ত প্রতীক তাজউদ্দিনের নাম অনুচ্চারিত ও ব্রাত্য থেকে গেল, অনুচ্চারিত থাকলেন রাজনীতির দুই শুদ্ধ পুরুষ অধ্যাপক মোজাফফর ও মণি সিং। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তো শুধু মোশতাক চক্র নয়, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিনের মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব সৃষ্টিকারী, তাজউদ্দিন বিরোধী সেই তরুণ তুর্কিদের দায় তো আরো বেশি। কেননা তাজউদ্দিন সরকারে থাকলে আপন প্রজ্ঞায় বঙ্গবন্ধুকে তিনি রক্ষার ব্যবস্থা করতে পারতেন। ’৭১-এ পেরেছিলেন ’৭৫-এও পারতেন। দল ও সরকারে না থেকেও নিজের জীবন দিয়ে তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর পূর্ণ অনুগত্য দেখিয়ে গেলেন।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসচর্চার সামষ্টিক ধারা আমরা অনুধাবন করতে পারিনি বলেই ’৭৫ পরবর্তী শাসকদের সূচিত ইতিহাস, বিকৃতির ও বিস্মৃতির এক প্রলম্বিত ছায়ার নিচে এদেশে বেড়ে উঠেছে আত্মপর ও বিভ্রান্ত এক প্রজন্ম। মনে হচ্ছে আমরা যেন ‘সকল নিয়ে বসে আছি এক সর্বনাশের আশায়।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধচন্দনাইশে ১ চেয়ারম্যান ও ২ সদস্য প্রার্থীকে জরিমানা