বিস্মৃতপ্রায় নেতা অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী

মুহাম্মদ শামসুল হক | সোমবার , ৩ অক্টোবর, ২০২২ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের যে কজন রাজনৈতিক নেতা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আন্তরিকতা ও নি:স্বার্থভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী। লেখাপড়ায় মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত ও ব্যক্তিগত জীবনে অর্থের প্রতি নির্লোভ এই নেতা পাক-ভারত বিভক্তির আগে ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে রাজনীতির পাশাপাশি অধ্যাপনা, আইন পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথমে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং পরে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহকর্মীদের একজন হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্য, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য এবং প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে কাছে থেকে দেখা রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শায়েস্তা খান বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, যুক্তিবাদী ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং নিঃস্বার্থ আওয়ামী লীগার।’ মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক কাজী শামসুল ইসলাম বলেছেন, ‘তাঁকে (নুরুল ইসলাম চৌধুরী) আমি কাছে থেকে দেখেছি সিটি কলেজের শিক্ষক হিসেবে, রাজনীতির মাঠে এবং মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শঠতা, মিথ্যা, অহংকার ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে দেখিনি।’
মুক্তিযোদ্ধা এমএন ইসলাম, কাজী আবু তৈয়ব, চৌধুরী মাহবুবুর রহমান স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী কখনো মিথ্যা আশ্বাসে কর্মীদের প্রলুব্ধ করতেন না। প্রশাসনে অন্যায় প্রভাব খাটানো, স্বজনপ্রীতি এবং যেনতেন প্রকারে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা তিনি করেননি। এমনকি স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে লাইসেন্স-পারমিট কিংবা চাকরির সুবিধা দিতে না পারায় কেউ কেউ তাঁকে ভুলও বুঝেছেন। তিনি কর্মীদের নীতি-নৈতিকতা মেনে চলার পরামর্শ দিতেন। একজন সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হয়েও তিনি অর্থ সংকটে দিন কাটিয়েছেন, সাদাসিধে জীবন করেছেন। এমনকি সৎভাবে রাজনীতি করতে গিয়ে নিজের পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে (লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার)।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৭ সালের ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার গোবিন্দরখীল গ্রামের হাদু চৌধুরী বংশে। তাঁর বাবা প্রয়াত আবদুস ছমদ চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশের দারোগা (ছমদ দারোগা নামে এলাকায় পরিচিত)। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও লেখাপড়া করতে হয়েছে নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে। তিনি ১৯৪২ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯৪৪ সালে কলকাতা স্কটিস চার্চ কলেজ থেকে আই, এ এবং ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি, এ পাস করেন। পরে ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এম, এ এবং ১৯৫৪ সালে এল, এল, বি ডিগ্রি লাভ করেন।
স্কুল জীবনেই তিনি ছাত্র রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৪৬-৪৭ সালে তদানীন্তন বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম ছাত্রবাস থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৫১ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সক্রিয় ভূমিকা রাখেন মহান ভাষা আন্দোলনে।
নুরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৫২ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা যুবলীগের সভাপতি, ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আইন পেশায় সম্পৃক্ত ছিলেন।
অধ্যাপক চৌধুরী ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভায় প্রথমে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং পরে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়া, তিনি বিভিন্ন পেশাজীবী ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী শাখার সহ-সভাপতি, ঢাকাস্থ পটিয়া সমিতির সভাপতি এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, পটিয়া কলেজ, আইন কলেজ ও আর্য সঙ্গীত বিদ্যালয় পরিচালনায় সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ২৬ মার্চ পটিয়ায় গঠিত স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা হন তিনি এবং স্থানীয় তরুণ-যুবকদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় এক নম্বর জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং পূর্বাঞ্চল যুব শিবিরের এক নম্বর সেক্টরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে অন্য অনেকের মতো বন্দুকের নলের মুখে তিনিও খন্দকার মোশতাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিলেও এ নিয়ে আমৃত্যু অনুশোচনায় ভোগেন এবং এক পর্যায়ে রাজনীতি থেকে বিরত থাকেন। ১৯৯৫ সালে ৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে সাতটায় চট্টগ্রাম নগরের একটি ক্লিনিকে অসুস্থ অবস্থায় ৭০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। একজন নির্লোভ, নিরহংকার, সাধারণ সাধাসিধে জীবন-যাপনকারী নেতা এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক: সম্পাদক, ইতিহাসের খসড়া, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে আইনী সুরক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর শিক্ষা ভাবনা ও শিক্ষকদের সম্মান