বিস্ময়কর প্রাণী অ্যাক্সোলটল

মোখতারুল ইসলাম মিলন | বুধবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:৩৮ পূর্বাহ্ণ

অ্যাক্সোলটল একটি অনন্য এবং রহস্যময় জলজ প্রাণী, যা সাধারণ মানুষের কাছে কম পরিচিত হলেও জীববিজ্ঞানী এবং গবেষকদের মধ্যে অত্যন্ত প্রিয়। মেক্সিকোর স্থানীয় এই উভচর প্রাণীটি তার সৌন্দর্য এবং পুনর্জন্ম ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত। অ্যাক্সোলটলকে মেক্সিকান ওয়াকিং ফিশবলা হলেও এটি প্রকৃতপক্ষে একটি উভচর প্রাণী, মাছ নয়।

অ্যাক্সোলটলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর চেহারা। প্রায় ১৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার লম্বা এই প্রাণীর শরীর বেশ নরম এবং মসৃণ, যা সাদা, গোলাপি, বাদামী বা কালো রঙের হতে পারে। এদের মাথার দুপাশে ফ্রিলের মতো দেখতে গিলস বা শ্বাসযন্ত্র থাকে, যা সাধারণত গোলাপি বা লালচে হয়। এই গিলগুলিই অ্যাক্সোলটলের প্রধান শ্বাসপ্রক্রিয়ার উপাদান, যদিও এটি ফুসফুসের সাহায্যেও শ্বাস নিতে পারে।

অ্যাক্সোলটলের আরেকটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো নিওটেনি। সাধারণ উভচর প্রাণী যেমন ব্যাঙ বা সালামান্ডার জীবনচক্রের একটি পর্যায়ে পূর্ণবয়স্ক হতে মেটামরফোসিস (রূপান্তর) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়, কিন্তু অ্যাক্সোলটল মেটামরফোসিসে না গিয়ে সারাজীবন লার্ভার মতো থাকতে পারে। অর্থাৎ, এটি প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করলেও লার্ভা অবস্থায়ই থেকে যায়, যা জীববিজ্ঞানীদের কাছে একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়।

অ্যাক্সোলটলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল এর অসাধারণ পুনর্জন্ম ক্ষমতা। এই প্রাণী তার হারানো অঙ্গ, যেমন পা, লেজ, এমনকি মস্তিষ্কের কিছু অংশও পুনরায় গজিয়ে তুলতে পারে। এটি একবার নয়, বারবার এমন করতে সক্ষম। এই ক্ষমতার কারণে অ্যাক্সোলটল চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়। বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীর পুনর্জন্ম প্রক্রিয়া থেকে মানুষের অঙ্গ পুনরুদ্ধার বা আঘাতের চিকিৎসা সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

অ্যাক্সোলটলের প্রকৃত বাসস্থান মূলত মেক্সিকোর জোচিমিলকো এলাকার হ্রদ এবং খাল। তবে এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নগরায়ন, দূষণ এবং হ্রদের শুকিয়ে যাওয়ার কারণে। এর ফলে, অ্যাক্সোলটল আজ বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে এই প্রাণী বন্য পরিবেশে খুব কমই দেখা যায়, এবং এর সংখ্যা দিন দিন কমছে। এদের সংরক্ষণের জন্য অনেক প্রকল্প হাতে নেওযা হয়েছে।

অ্যাক্সোলটলের পুনর্জন্ম ক্ষমতা গবেষণা ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীর ডিএনএ এবং কোষ পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন, যাতে মানবদেহে অঙ্গ পুনর্গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। বিশেষ করে, মস্তিষ্ক এবং স্পাইনাল কর্ডের পুনর্জন্মের গবেষণায় অ্যাক্সোলটল এক অসাধারণ মডেল প্রাণী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অ্যাক্সোলটল শুধু বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেনি, এটি জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও জায়গা করে নিয়েছে। এর মিষ্টি চেহারা এবং অদ্ভুত স্বভাবের কারণে এটি পোষা প্রাণী হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিভিন্ন ভিডিও গেম, অ্যানিমেশন, এবং শিল্পকর্মেও অ্যাক্সোলটল একটি প্রিয় চরিত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

অ্যাক্সোলটল একটি অসাধারণ প্রাণী, যার সৌন্দর্য, চিরকাল লার্ভা অবস্থায় থাকা, এবং পুনর্জন্মের ক্ষমতা একে প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে এর প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংসের কারণে এটি এখন বিপন্ন প্রজাতি। এ প্রাণীটির সংরক্ষণ এবং গবেষণার জন্য আমাদের বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত, কারণ এর পুনর্জন্ম ক্ষমতা ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী আবিষ্কারের দরজা খুলে দিতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভোরের মায়া
পরবর্তী নিবন্ধকৃষক ও তার বুদ্ধিমান ছাগল