নেশাগ্রস্থ রাতের ভেতর আমরা তিনজন চাঁদের পেয়ালা হাতে বসি। ঢকঢক পান করি অমাবস্যা ও অন্ধকার। জ্যোৎস্নার সবটুকু গরল পান শেষে আমাদের কাছে আর চাঁদের টুকরা–টাকরা অবশিষ্ট থাকে না।
বেশ বড় একটি চাঁদ দেখেছি আজকে, গাড়ি থেকে নেমে, আমরা যখন হাঁটছিলাম, ডাবের মতো একটা চাঁদ, গোল–ঘূর্ণায়মান চাঁদ–আমাদের পথকে মেপে সাক্ষি হয়ে যাচ্ছিল। আমরা যাচ্ছিলাম গোমতির বেড়িবাঁধ ধরে। আমাদের পায়ের নিচে ধূলো আর চারপাশে সবুজের অবারিত উদ্বাহু আবহ আমাদেরকে নেশাসক্ত করছিল এবং আমরা শীঘ্রই পথ ফেলে, গন্তব্য ফেলে নদীর চরায় নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং কথা–কাজ রাখতে আমরা নেমে পড়লাম সত্যি সত্যি।
নদীর জলে কুমির ছিল। মরাগাঙে অসময়ে জোয়ার ছিল। প্রচণ্ড শীতের রাত্রিতেও আমরা বর্ষা দেখে চমকে চমকে উঠেছি। আমরা চাঁদটাকে নেমে যেতে দেখলাম আমাদের সাথে জলে এবং লুকোচুরি খেললো তারকারাজি–যারা ফুটে ছিল আকাশে এবং আরও আরও নীলরং আকাশ, পৌষের ধূসর ধূয়াশা–সবই আমাদের সাথে নামলো এবং আমরা যখন সিনান করতে নিজেদের অনাবৃত করতে থাকি তখন চাঁদও তার সমস্ত কলঙ্কের আভরণ খুলে ফেলে আমাদের সাথে নিরাভরণা হয়ে পড়ে আর তারাগুলো তাদের নীলচে আলোর বলয় থেকে বেরিয়ে নদীর শুকনো, মরা সোঁতা ধরে ভেসে যেতে থাকে। আমরা দেখি, চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে আর আমরা ভাবতে বসছি কার ঘরে আজ কতটা বাতি জ্বলছে। তখন আমাদের মনে হলো, না, এই নদীর চরায়, হাঁটু পানিতে, ঠাঁই পানিতে আমাদের ভিজিয়ে রাখা দেহজ বাস্তবতার নিষুপ্তপাঠ তেমন জোরালো হচ্ছে না এবং আমরাও চাঁদ থেকে, নদী থেকে, এমনকি অসময়ের স্মৃতি–তড়পানো বর্ষা–হঠাৎ উপচানো উগলানো নদীও আমাদের বিস্ময় জাগাতে পারছে না। আমরা সবিশেষ মুক্তি চাইছিলাম রাত থেকে, চাঁদ থেকে এবং নক্ষত্রের নীল আলো থেকে। আমরা হয়তো মুক্তি চাচ্ছিলাম ধূলা ও ধূলাবস্তু মানব–মন থেকে। আমরা হয়তো মুক্তি চাচ্ছিলাম সবুজের উদ্বাহু আহ্বান থেকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তাৎক্ষণিক কোনো চিন্তা বা পরিকল্পনা আমাদের মনের ভেতর আসে না এবং তাই আমাদের মনে হয়, চাঁদ নয়, নদীর জল নয়, ধূয়াশার আকাশ নয়, আমরা নই–নেশাগ্রস্থ আসলে হয়েছে রাতটা, যা আমরা দিনের ভুল ব্যবহারে নিজেদের জন্য রপ্ত করেছি।
আমাদের চাঁদের পেয়ালা উপচাতে থাকে। আমাদে শিশুমন উগলাতে থাকে। কোনো ঢেউশূন্য ঢেউ, কোনো বিরামহীন দৃশ্যচিহ্নের অনুসূয়া দীপিতা দ্বিতীয় বারের মতো আমাদের পথ ও গন্তব্য ভুলিয়ে দিলে আমরা মনে করি, না চাঁদ, না চাঁদের পেয়ালা– কোনোকিছুই যখন আমাদের মনঃপুত নয় এবং জল–ছলছল নদী, কিংবা যদি বলো এই রাত : তাও আমাদের ঘোরগ্রস্ত করার জন্য যথেষ্ট অন্ধকার ধারণ করতে পারে না তখন আমাদের মনে হলো পাতালরাজ্যে যাই। পাতালরাজ্যে যাওয়ার পথ আমাদের বাতলে দেয় সুজন। সুজন আমাদের মধ্যে বয়সে সামান্য বড়। সে আমাদেরকে শোনায় সেই গল্প, যেখানে এক রাজার ছেলে, মন্ত্রীর ছেলে আর আর এক রাখাল পাতালরাজ্যে যাওয়ার সময় রাজকন্যার জন্য তিনটি উপহার নিয়ে যায়। রাজার ছেলে নেয় এক আশ্চর্য পাখা, যা দিয়ে বাতাস করছে ছয় মাসের মৃতমানুষও জীবিত হয়ে যায়। আর মন্ত্রীর ছেলে নেয় এক আজব আয়না, যাতে আসমান জমিন পাল–তিনভূবনের সবকিছু দেখা যায় এবং আয়নাকে যদি নির্দেশ দেওয়া হয় সেখানে নিয়ে যেতে তাহলে চোখের পলকে আয়না সেখানে নিয়ে হাজির করে। আর রাখার নেয় সাধারণ একটা তাতের শাড়ি। তো, যেতে যেতে পথে তারা শিকার করে। নীলতিমির পেটে হারপুন ঢুকিয়ে দেয়। জলহস্তির হা–মুখের ভেতর ছুড়ে মারে ডিনামাইট আর স্নাইপার দিয়ে তুলে নেয় সামুদ্রিক ঈলের জলবিদ্যুৎ। এভাবে যেতে যেতে তারা বছরের পর বছর সময় নেয় কারণ রাজার মেয়ের আঠারো বছর হতে এখনো বাকি এবং আঠারো বছর না হলে রাজার মেয়ের বাগদান হবে না। তো, হঠাৎ একদিন কী মনে করে তারা আয়নার কাছে দেখতে চায় পাতাল রাজ্যের রাজকন্যাকে। তারা দেখে, রাজার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে আজ পাঁচমাস উনত্রিশ দিন। তারা আর কালবিলম্ব করে না, তৎক্ষনাৎ আয়নার ক্ষমতার মাধ্যমে পাতালরাজপুরীতে পৌঁছে রাজকন্যার কবর খোলার ব্যবস্থা করে। কবরের মুখ খোলা হলো রাজার ছেলে হাত বাড়িয়ে পাখা দিয়ে বাতাস করে মরা লাশের গায়। রাজার মেয়ে জীবিত হয়ে উঠে। কিন্তু বাইরে বেরোবে সে কীভাবে? ছয়মাসের পচা কাফন, উঠলেই ঝুরঝুর করে গা থেকে খসে পড়বে। রাখাল ছেলে তাঁতের শাড়ি এগিয়ে দেয়। তা পরেই রাজকন্যা কবর থেকে উঠে এবং সেদিনই তার আঠারো বছর পূর্ণ হয় এবং সে বাগদান অনুষ্ঠানে জানায়–জীবনের চেয়ে সম্ভ্রমের দাম বেশি।
আমরা রাখাল ছেলের বাঁশির সুর শুনি। পাতালরাজ্যে চুপটি করে, মীনের সাথে মীন হয়ে, কাদা হয়ে, পলি হয়ে, স্রোতের শেওলা হয়ে আমরা নদীর অন্তস্থলের কথা শুনি। শুনি রাজার মেয়ে ও রাখালের হাসি–খুনসুটি। ঝিনুকের ভেতর মুক্তো আমাদের চোখের পলকে তৈরি হয়ে যায়। আমরা দেখি, কীভাবে বাইন তার দেহকে বাঁচিয়ে রাখে কর্দম থেকে এবং আমরা শুনি সামান্য বালিকণা নড়ে যাবার শব্দ, যা জলের নিচে স্থিরজলের ঢেউহীন ভেসে চলা অকল্পবাস্তব–এবং নদীটি যেহেতু পৌষের এবং নদীতে যেহেতু হঠাৎজোয়ার এবং আমরা অতলে তাই জল ও শীত, পাতাল ও স্থলভাগ, এমনকি আকাশও আমাদের স্পর্শের অতীত হয় না। আমরা দেখি, পাতালরাজ্যের রাজপ্রাসাদে আমাদের সুখ নেই। আমরা অনুভব করি, রাজার মেয়ের যে রূপ, তা আমাদের চোখের সামনে সবকিছু ঝলসে দিতে যথেষ্ঠ নয় এবং আমাদের যে পথভোলা গন্তব্যভোলা মন, পাতালরাজা সে মনের মানুষ নয়। আমাদের চোখ খুলে দেয় আরিফ। সে বলে, ওই দেখো, চাঁদ কেমন মিটিমিটি হাসছে। আমরা আবার দেখি, চাঁদের টুকরোগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে এবং না জানলেও আমরা বুঝতে পারি, আকাশটা কাঁদছে।
প্রচণ্ড রাতের ভেতর, এক মাতাল রাতের ভেতর আমরা চাঁদের পেয়ালা নিয়ে বসি। বেড়িবাধের এ পাড়ের কলেজের মাঠে ঘাসে শিশির পড়ছে টুপটাপ। আমরা ভিজতে থাকি। জোনাকিরা নিভে গেছে। কোথাও আলো নেই একটুকরো। মাঠের উত্তরে আগাছা বেড়ে ঝোপ হয়ে আছে। জমাট স্তব্ধতার ভেতর আমরা রাতের নিশ্বাস শুনি। আকাশ ও দিগন্ত মুছে যেতে দেখি। ঢকঢক পান করি অন্ধকার, অমাবস্যা, রাতের কুহক, পথভোলা–গন্তব্যভোলা অভিসার।
আমাদের চাঁদের পেয়ালা ফুরোয় না। জ্যোৎস্নার সবটুকু গরল পান শেষে আমাদের কাছে আর চাঁদের টুকরা–টাকরা অবশিষ্ট থাকে থাকে না। রাত আরও বাড়ে। দীর্ঘঘুমের–ডানা ভেঙে পাখিরা প্রহর অতিক্রান্তির সাক্ষিরূপ ডেকে উঠে। তারকারা আড়মোড়া ভাঙে কুয়াশার আড়ালে, সে শব্দ টের পাই। আমরা তখন আকাশ ও নক্ষত্র পেয়ালাভরে পান করি, পান করি রাতের বৈভব। আর আজলাভরা নৈঃশব্দ্য পান করি। নীরবতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে, কিংবা আমরা চলে গেলে অন্ধকারের শেষ সীমানায়, আমাদের পায়ের রগে রগে টান পড়ে। আমরা টের পাই, জমিনের সাথে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আমাদের শেকড়, আমরা গাছমানব হয়ে যাচ্ছি, আর নিষ্ঠুর কাঠুরে কেটে ফেলছে আমাদের। আমাদের চোখে ঘুম পৌষের শেষরাতের কুয়াশার সমান্তরালে নামে, তবু বিস্ফারিত হতে থাকে আমাদের চোখ। আমাদের চিন্তায় হিম নামে, তবু বিস্ফোরিত হতে থাকে আমাদের চেতনা।












