অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কারের জন্য বেশ কিছু কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে একটি হলো জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। উক্ত কমিশন বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস পরিবর্তন করে ৬টি আবশ্যিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছে। পাশাপাশি পরীক্ষার নম্বর পুনর্বণ্টন করে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বিষয়টি সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। জানিনা কি মনে করে কমিশন এটি করলো। ভালো গণিত জানা লোক সরকারের অংশ হলে কি ক্ষতি সেটা বুঝে উঠতে পারলাম না। বর্তমানে সরকারের অংশ হয়ে কাজ করছেন সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার। যতদূর জানি তিনি সরাসরি গণিতের ছাত্র ছিলেন। আমলা হিসেবে উনারতো যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। গণিত থাকাতে কি বিজ্ঞানের ছাত্ররা বিসিএসে বেশী হারে ঠকছে নাকি অন্য কোন কারণ কমিশন খুঁজে পেয়েছে তাও চিন্তার বিষয়। এই চিন্তা থেকেই ভাবনা আসে বিশ্ব গণিত দিবসে, গণিতের মূল্যায়ন কি কমে যাচ্ছে আমাদের দেশে?
এবার আসি বিশ্ব গণিত দিবস পালনের উদ্দেশ্য নিয়ে। প্রথমত এটির একটি উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী গনিতপ্রেমীদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ব্যবধান পূরণ করা, কারণ গণিত একটি সার্বজনীন ভাষা যা দেশীয় সীমানা অতিক্রম করার মত গ্রহণযোগ্যতা সর্বক্ষেত্রে। এ দিবসটি উদযাপনের মাধ্যমে, দেশ এবং সম্প্রদায়গুলি গণিতের সার্বজনীন ভাষা প্রচারের জন্য একত্রিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত ১৪ মার্চ তারিখটি আরও একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ, এদিন অন্যতম সেরা গণিতবিদ এবং পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন। অতএব তাঁকে স্মরণ করাও একটি উদ্দেশ্য। গণিত এবং বিজ্ঞানে তাঁর অবদান নতুন প্রজন্মের চিন্তাবিদদের অনুপ্রাণিত করে, এই দিনটিকে স্মরণ করা মানে তাঁর যুগান্তকারী কাজের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে তুলে ধরার একটি মহৎ প্রচেষ্টা। আর একটি হলো বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত ক্ষেত্রগুলির গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া এবং শিক্ষার্থীদের এই ক্ষেত্রগুলিতে ক্যারিয়ার গড়তে উৎসাহিত করে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে গণিত এবং বিজ্ঞান যে উদ্ভাবন করে যাচ্ছে তার গুরুত্ব অনুধাবন এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়া। আমরা জানি পাই এর মান প্রায় ৩.১৪। একারণেই প্রতি বছরের তৃতীয় মাস মার্চের ১৪ তারিখ পাই দিবস হিসেবে পালিত হয়। আইনস্টাইন যেমন এইদিনে জন্মেছিলেন আবার এই দিনেই মৃত্যুবরণ করেন আরেক বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং। আবার মার্চের ১৬ তারিখেই মৃত্যুবরণ করেন আমাদের দেশের গাণিতিক পদার্থবিদ প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের জন্ম ও মৃত্যু দিবস গুলো পাই– দিবসের দিন বা কাছাকাছি সন্নিবেশিত থাকা কি কোন কিছুর ইঙ্গিত দেয়?
এবার বিশ্ব গণিত দিবসের থিম হল, ‘গণিত, শিল্প, এবং সৃষ্টিশীলতা’। গণিতের এদিনটি আমাদের সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানকে অনুপ্রাণিত করে কারণ গণিতকে প্রায়শই সমস্যা সমাধানের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। সুতরাং এ গণিত দিবস হল বর্তমান বিশ্বের সমস্যা সমাধানের জন্য গণিত কীভাবে সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করা হয় তা প্রদর্শনের একটি সুযোগ। এদিবসকে কেন্দ্র করে আয়োজিত ইভেন্টগুলিতে প্রায়শই গাণিতিক ধাঁধা, পোস্টার, চ্যালেঞ্জের সমাধান এবং বিভিন্ন প্রদর্শনী থাকে যা অংশগ্রহণকারীদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা এবং সমস্যা সমাধানে জড়িত করে। যদিও বাংলাদেশে পাই দিবস সরকারীভাবে বা মূলধারায় উদযাপন করা হয় না, তবুও বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত–এর বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের ফলে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পাই দিবস উদযাপন ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে! চুয়েট গণিত ক্লাব এবার বেশ কিছু সৃজনশীল উদ্যোগের মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করছে শিক্ষার্থীদের নিয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গণিত ক্লাব ও এশিয়ান উইমেন ইউনিভার্সিটি গণিত ক্লাব য়ৌথভাবে দিনটি উদযাপনের আয়োজন করেছে। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জাঁকজমক পূর্ণভাবে এদিবসটি পালন করে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির একাডেমিক সদস্যরাও এই দিবসটি উদযাপনের জন্য বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলোতে যোগদান করেন। বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশে ক্রমশই গণিতের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
সাধারণত ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি অঙ্ক মানে শুধু অনুশীলনের সমস্যাগুলো সমাধান করা। সমস্যাগুলো সমাধান শুরুর আগে অধ্যায়ের শুরুতে বিষয় সম্পর্কিত কিছু বর্ণনা ও সমাধানের নিয়মাবলী দেওয়া থাকে। এ বর্ণনা গুলো পড়ে দেখার যে একটা সংস্কৃতি, সেটা আমাদের দেশের বাচ্চাদের নেই বা শিক্ষকরা সেটা কখনো পড়তে বলেন না। শিক্ষকরা বললেও শিক্ষার্থীরা সেটা পড়ে না। আমার মতে, এটা একটি বড় সমস্যা গণিত না বোঝার ক্ষেত্রে। অন্য সমস্যাটি হলো কিছু কিছু শিক্ষার্থী না বুঝে অঙ্ক মুখস্থ করার চেষ্টা করে। একবার আমি এমন এক শিক্ষার্থীকে পেয়েছিলাম, যে সমাধানের অঙ্ক গুলো বড় বড় করে রিডিং পড়ছে আর মুখস্থ করছে। অনেকটা বাংলা বা সমাজ পড়ার মতো। বোঝার বা অনুধাবন করার কোন চেষ্টাই করছে না। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে মুখস্থ করার ব্যাপারটি আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজগতে একটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছে, যা একটি ভয়াবহ ব্যাপার। কলেজ পর্যায়ে আমাদের দেশের গণিতের পাঠ্য বইগুলো দেখলে দেখা যায়, অঙ্ক গুলোর পাশে কোনটি কোন বোর্ডে কতবার পূর্বে বিভিন্ন বোর্ডে আসছে তা সুন্দর করে উল্লেখ করা থাকে। ৯০ এর দশকে একটা প্রচলিত নিয়ম ছিল কিছু অঙ্ক এক বছর বাদে আরেক বছর আসবেই। এগুলোকে আমরা জোড় সাল ও বিজোড় সাল অঙ্ক বলতাম। এই ব্যাপারগুলিই সাধারণত মুখস্তকে এবং নকলকে উৎসাহিত করে থাকে। এ ধারা থেকে আমাদের বের হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এমনকি কারিকুলাম পর্যন্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে, স্কুলে এখনো অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা উনাদের নিয়মে অঙ্কটা সমাধান না করলে শিক্ষার্থীদের নম্বর দেবেন না। কিন্তু মুল ব্যাপার হল একটা অঙ্কের সমাধানটা বিভিন্নভাবে করা যায়। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাথে যুক্ত থাকার কারণে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কোন কোন শিক্ষার্থী আমরা যে নিয়মগুলো জানি তার বাইরেও অন্য সৃজনশীল নিয়মে সমস্যাটি সমাধান করেছেন। এর জন্য সমাধানকারীকে সৃজনশীল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। স্কুলে হলে উক্ত শিক্ষার্থীকে ‘বেশী বুঝে‘ বলে অনেক শিক্ষক শূন্য বসিয়ে দেন। এ ধরনের মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এখন অবশ্য অনেক পরিবর্তন এসেছেও।
যাইহোক শুরু যেটা দিয়ে করেছিলাম সেটা দিয়ে শেষ করতে চাই। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের সাথে কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, আপনি কি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য পরিমার্জিত গণিত নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের শুরুতে প্রসঙ্গ–কথা পড়েছেন? ওখানে আছে-‘একুশ শতকের এই যুগে জ্ঞান–বিজ্ঞানের বিকাশে গণিতের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে গণিতের প্রয়োগ অনেক বেড়েছে।’ তারপর সরকারের উদ্দেশ্যে তাঁর জিজ্ঞাসা– ‘জাতির সামনে আমাদের সন্তানদের উদ্দেশ্যে যদি একথা বলে থাকেন ও বিশ্বাস করেন, তাহলে জ্ঞান–বিজ্ঞানের এ যুগে কিভাবে বিসিএস থেকে গণিত তথা গাণিতিক যুক্তি বাদ দেওয়ার চিন্তা আসে তা অন্তত আমার বুঝে আসেনা। গণিতকে বাদ না দিয়ে বরং আরো যুগোপযোগী করে বিসিএস পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি’। বিশ্ব গণিত দিবসকে সামনে রেখে আমরাও সেটা প্রত্যাশা করি।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।