খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ের অন্যতম নদী মাইনী। নদীর নামানুসারে এই অঞ্চলের সমতল ভূমি মাইনী উপত্যকা নামে পরিচিত। প্রায় ১০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীর তীরজুড়ে মানুষের বসতি ও ফসলি জমি বিস্তৃত। বিশেষত দীঘিনালার বাবুছড়া, বড়াদাম, পাবলাখালী, বোয়ালখালী, তারাবুনিয়া ও মেরুং এলাকায় এই উপত্যকা প্রসারিত। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মাইনী তীরে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই উদ্যোগে বর্তমানে ৪০ জন কৃষক অংশ নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন তুহিনা চাকমা। তিনি দীঘিনালা–বাবুছড়া সড়ক সংলগ্ন শনখোলা পাড়ায় ২০ শতক জমিতে শুরু করেছেন খিরা চাষ। তিনি বলেন, আমার ক্ষেতে কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার করা হয়নি। জৈব সার এবং কেঁচো সার ব্যবহার করেছি। এছাড়া নতুন প্রযুক্তি হিসেবে ভার্মি ওয়াশ প্রয়োগ করেছি। আমার উৎপাদিত ক্ষীরা সম্পূর্ণ বিষমুক্ত এবং স্বাস্থ্যকর।
তুহিনা চাকমার মতো বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে ভার্মি সার ও ভার্মি ওয়াশ উৎপাদন করছে বড়াদাম এলাকার নারী উদ্যোক্তা রেশমি চাকমা। সরেজমিনে দেখা যায়, নিজের বসতবাড়ির আঙিনায় ভার্মি সার উৎপাদন করছেন রেশমি চাকমা। তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যে আমার ক্ষেতের জন্য ভার্মি ওয়াশ ও ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছি। কীটনাশকের পরিবর্তে ভার্মি ওয়াশ ব্যবহার করার উপকার হল– গাছে রোগের আক্রমণ কম হয়। এছাড়া এটি প্রকৃতিবান্ধব। এছাড়া বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে আমরা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করি। রাসায়নিকের চেয়ে খরচ কম। এছাড়া ফসলের পোকা দমন করার জন্য নীল পাতার রস ব্যবহার করি। ফলনও ভালো পাচ্ছি।
দীঘিনালা বানছড়া এলাকার কৃষক শৈলেন্দ্র প্রসাদ চাকমা বসতবাড়ির পুকুরে বিষমুক্ত লাউ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। তার পুরো বাড়িজুড়ে নানা রকমের সবজি আবাদ। তিনি বলেন, আগে আমার জমিতে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতাম। প্রাকৃতিক উপায়ে রাসায়নিকমুক্ত উপায়ে চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা ছিল না। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে জেনেছি। সেভাবেই লাউ উৎপাদন করছি। প্রাকৃতিক উপায়ে চাষকৃত লাউয়ের দাম ভালো। মাঝে মাঝে নীল পাতার রস ব্যবহার করি। প্রকৃতিবান্ধব এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে ফসলের উৎপাদনও বেশ ভালো এবং মানুষের জন্য স্বাস্থ্যকর।
একই এলাকার চাষি ইমেজ চাকমা বলেন, এর আগের বছরও আমরা রাসায়নিক দিয়ে শসা বা অন্যান্য শাক–সবজি চাষ করতাম। কিন্তু এ বছর আমরা সর্ম্পূণ প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করছি। আমার পুরো শসা ক্ষেতে যাতে কোনো ক্ষতিকর পোকা প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নেট দিয়েছি। এভাবে যদি সবাই চাষ করে আমরা স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগ্রহণ করতে পারব। এখন রাসায়নিক বা কীটনাশকের কারণে রোগবালাই দেখা দিচ্ছে, সেটা থেকে মুক্তি পাব। আমি শসার পাশাপাশি বিষমুক্ত টমেটো উৎপাদন করছি।
বেসরকারি সংস্থা তৃণমূল এর প্রোগ্রাম অফিসার স্যুইচিং অং মারমা বলেন, হেলভেটাস সুইস ইন্টার কোঅপারেশন এবং আইসিমড অর্থায়নে পরিচালিত ‘প্রোমোটিং জেসি–আই রেসপনসিভ নেচার–বেসড সলিউশনস ফর এনাবলিং রেজিলিয়েন্স ইন সিএইচটি অব বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় আমরা কৃষকদের প্রাকৃতিক উপায়ে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে চাষাবাদে উৎসাহিত করছি। লক্ষ্য হল পরিবেশ ও জলবায়ুর উপর নেতিবাচক প্রভাব কমানো এবং মানুষকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করা। এছাড়া দীঘিনালা ব্যাপক হারে তামাক চাষ হচ্ছে। কৃষক যাতে তামাকের পরিবর্তে সবজি উৎপাদনে আগ্রহী হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি।
বিষমুক্ত ফসলের উৎপাদনকে স্বাগত জানিয়েছে কৃষি বিভাগ। দীঘিনালার কৃষি কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে প্রকৃতি ভিত্তিক প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। ভার্মি ওয়াশ নতুন হলেও এটি ফসলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। প্রাকৃতিক উপায়ে চাষাবাদের ফলে উপকারী পোকা সংরক্ষিত হয়। আমরাও বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন ছড়িয়ে দিতে কাজ করছি।












