বিশ্বের বড় অংশ যখন করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায়, যুক্তরাষ্ট্র তখন কেবল বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিনই মজুদ করেনি, কাঁচামাল ও সরঞ্জামেরও বড় মজুদ গড়েছে। কীভাবে তা সম্ভব হলো? টিকা উৎপাদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি কাঁচামালসহ সরঞ্জাম পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলো অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর সরকার পেয়েছে টিকাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই মজুদদারির কারণে টিকা নিয়ে সংকটে থাকা কিছু দেশ দুরবস্থায় পড়েছে; তাদের বিকল্প সংস্থান হচ্ছে না। এর প্রভাব টিকা সরবরাহ ব্যবস্থাতেও পড়ছে। আর তাতে বৈষম্য বাড়ার চিত্র উঠে এসেছে সরবরাহকারী, অন্য দেশের উৎপাদক ও বাজার বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে। খবর বিডিনিউজের।
কোভিড-১৯ টিকার পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ চুক্তি সাময়িকভাবে শিথিলের জন্য যারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপে রেখেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাতে সমর্থন দেওয়ায় তারা উচ্ছ্বসিত। এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) ওই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হলে অন্যান্য দেশও নিজেরা টিকা উৎপাদনের সুযোগ পাবে। কিন্তু শুধু শর্ত শিথিল হলেই হবে না, টিকা বানাতে লাগবে উপকরণ আর প্রযুক্তি। পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব নিয়ে শোরগোলে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি আড়ালে পড়ে গেছে, তা হলো বিশ্বজুড়ে টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল ও উৎপাদন সরঞ্জামের ক্রমবর্ধমান সংকট। টিকা তৈরি জন্য অত্যাবশ্যকীয় ফিল্টার, টিউবিং ও বিশেষায়িত ডিসপোজেবল ব্যাগের মতো উপকরণ ও সরঞ্জামের বড় অংশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। ভারতসহ অন্য যেসব দেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিপর্যস্ত, প্রস্তুতপ্রণালী জানা থাকলেও এসব উপকরণ ও সরঞ্জাম ছাড়া তারা টিকা উৎপাদন বাড়াতে পারবে না। এই সংকটের গোড়ায় রয়েছে ১৯৫০-এর দশকে কোরিয়া যুদ্ধের সময় প্রণীত ডিফেন্স প্রোটেকশন অ্যাক্ট (ডিপিএ)। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে জাতীয় প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত কেনাকাটায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার জন্য বিগত ট্রাম্পের প্রশাসন ওই আইন ব্যবহার করেছে। এর ফলে আমেরিকার তৈরি টিকা ও অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার প্রাধান্য পেয়েছে। প্রতিদানে টিকা উৎপাদকেরা যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা পূরণের স্বার্থে টিকা বানানোর যেকোনো উপকরণ সংগ্রহে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার, ওষুধ কোম্পানি ও অন্যদের একত্রিত করে গড়ে তোলা জোট গ্যাভি বিশ্বজুড়ে টিকার সহজলভ্যতা বাড়াতে বাইডেন প্রশাসনের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকার সরবরাহ নিশ্চিত করতে গ্যাভি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মিলে গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক জোট কোভ্যাঙ। কোভ্যাঙে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতির কথাও গ্যাভির বার্তায় তুলে ধরা হয়েছে।
গ্যাভির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোভ্যাঙের লক্ষ্য অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় সংকট হলো বিশ্বে টিকা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেওয়া। কাঁচামাল রপ্তানিতে নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে মহামারীর স্থায়িত্বই বাড়বে। তবে বাইডেন প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
ভারতের আবেদন : টিকা উৎপাদনের জন্য দরকারি উপকরণ যুক্তরাজ্য ও চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়। কিন্তু থার্মো ফিশার সায়েন্টিফিক ইনকরপোরেশন ও ডানাহার করপোরেশনের অধীনে সিটিভা ও প্যালের মতো শীর্ষস্থানীয় সরবরাহকারীরা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক। টিকা উৎপাদনে দরকারি উপকরণের কতটা আমেরিকায় তৈরি হয় সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি রয়টার্স।
যুক্তরাজ্যের অঙফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ টিকা নিয়েছেন। অথচ দক্ষিণ আমেরিকার গুয়াতেমালা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ডের মতো অনেক দেশ এখন পর্যন্ত এক শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই বৈষম্যমূলক আইন ডিপিএ। সমালোচকদের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াও রয়েছে। ভারতীয় এ কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি টিকা উদ্ভাবক কোম্পানি নোভাভ্যাঙের সঙ্গে মিলে বছরে একশ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাঁচামাল না পাওয়া গেলে তাদের উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসবে।
অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত এবং এর লাইসেন্সের অধীনে কোভিশিল্ড নামে করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনুনয় বিনয়ের পর গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে টিকা উৎপাদনের ফিল্টার পাঠাতে রাজি হয়েছে। শুধু সেরাম নয়, কোষ কালচারের জন্য দরকারি বায়োরিঅ্যাক্টর ব্যাগের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার টিকা উৎপাদক কোম্পানি বায়োভ্যাকও যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। সরাসরি ডিপিএর কথা না তুললেও ফাইজার বলেছে, আমাদের ব্যাপক ধকল পোহাতে হয়েছে।
কল্পনাতীত চাহিদা : কিছু সরবরাহকারী মনে করে, বিশ্বজুড়ে কাঁচামালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সীমাবদ্ধ সম্পদের ব্যবস্থাপনায় সরকারের চেয়ে শিল্পখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোই ভালো কাজ করতে পারে। থার্মো ফিশারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিশেল ল্যাগারদে বলেন, যদি লক্ষ্যটি হয় টিকা উৎপাদন, তাহলে আমরা বিশ্বাস করি যে, আপনার উচিত শিল্পখাতকে সুযোগ করে দেওয়া, যাতে তারা কাঙ্ক্ষিত পণ্যটি উৎপাদনের জন্য সব ধরনের সংশ্লিষ্ট অংশ একত্রিত করতে পারে।
অন্য দেশের টিকা পাওয়া নিশ্চিত করতে অনেক সময় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে সরবরাহের তারিখ পরিবর্তন করতে পারেন। তবে সরবরাহকারীরা চাহিদার চেয়ে এগিয়ে থাকার পরিকল্পনা করছে।
সিটিভা বলেছে, যে তারা উৎপাদন বাড়াচ্ছে, কিন্তু নিজেরাই কিছু কাঁচামালের ঘাটতিতে রয়েছে। তাদের ভাষায়, বায়োফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য ও প্রযুক্তির একটি ‘অভূতপূর্ব চাহিদার’ মুখোমুখি হয়েছে বিশ্ব।












